হিল ভয়েস, ২২ মার্চ ২০২৩, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর (স্টেট ডিপার্টমেন্ট)-এর রিপোর্ট অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার নৃশংসতার শিকার হচ্ছে ।
গত সোমবার (২০ মার্চ) মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস: বাংলাদেশ’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে এই মতামত তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের “আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী” শীর্ষক বিভাগে বলা হয়েছে যে-
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এবং উচ্চ শিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য দেশব্যাপী সরকারি কোটায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায় ব্যাপক বৈষম্য ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বশাসনের বিধান থাকা সত্ত্বেও এই শর্তগুলি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি, বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যেমন- তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থার ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত চুক্তি অংশ বাস্তবায়িত হয়নি।
ভূমি কমিশন আইনের অধীনে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের বিষয়ে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির পদ্ধতি বিষয়ে অমত থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ভূমিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত-নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সংগঠনগুলো দাবি করেছে, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অবৈধ গ্রেপ্তার, মিথ্যা অভিযোগে আদিবাসীদের মারধর, হয়রানি, হুমকি এবং জেলে পাঠানো এবং অধিকার কর্মীদেরকে সন্ত্রাসী এবং চাঁদাবাজ হিসাবে চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ৯ই আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের জন্য আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানগুলিতে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য সব ধরনের প্রচার মাধ্যমকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
আদিবাসী কর্মীরা দাবি করেছেন যে, জনশুমারিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ব্যাপকভাবে কম দেখানো হয়েছে, যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন খাতের বাজেটকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। সরকারী জনশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ১৬.৫ লক্ষ সংখ্যালঘু (আদিবাসী) উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে জাতিগত সংখ্যালঘু জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ।
বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ হলেও সমতলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ দরিদ্র সীমায় বাস করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দারিদ্রের হার ৬৫ শতাংশেরও বেশি। সংস্থাগুলি নিশ্চিত করেছে যে, দেশের অ-আদিবাসী বাঙালী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত স্বাস্থ্যসেবার তুলনায় আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দকৃত স্বাস্থ্যসেবার মান অনেক বেশি অপ্রতুল বা কম।
একাধিক এনজিওর সূত্রমতে জানা যায়, এমনকি করোনা মহামারী চলাকালীন সময়েও , আকস্মিক চাকরি হারানোর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বসবাসকারী আদিবাসীদের মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়তে হয়। যেহেতু অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রত্যন্ত এলাকায় বসাবস করে, সেহেতু যাতায়াত ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় কোন সরকারী সহায়তা পায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে যতগুলো উচ্ছেদ এবং সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই সরকার, সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশে করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, একটি রাবার কোম্পানির লোকজন স্থানীয় আদিবাসীদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রামের পানির প্রধান উৎস ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়েছিল।
আগস্ট মাসে জাতিসংঘের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোটিয়র; অবৈধ গ্রেপ্তার ও আটকের উপর জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ; বিচারবহির্ভূত, সাজানো বা অবৈধ মৃত্যুদন্ড বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোটিয়র; এবং বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষা সম্পর্কিত জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোটিয়র সামরিক হেফাজতে আদিবাসী রাজনৈতিক কর্মী নবায়ন চাকমা মিলনের কথিত নির্যাতন এবং পরবর্তীতে মৃত্যুর বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন। তারা মিলনের মৃত্যুর অবিলম্বে তদন্তের দাবি জানান।
জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে, “এটি আমাদের নজরে আনা হয়েছে যে, আদিবাসী জনগণ, আদিবাসী অধিকার কর্মী এবং আদিবাসী রাজনৈতিক কর্মীরা বারবার পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ গ্রেফতার, নির্যাতন, জীবনযাপনে নির্বিচার বঞ্চনা এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। তদুপরি, প্রায়শই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অভিযান, তল্লাশি, গ্রেপ্তার চালিয়ে আসছে। অথচ এক্ষেত্রে যেমন- তল্লাসী, গ্রেপ্তার বা উভয়ে ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট প্রদর্শন কোনটিতেই আইনি প্রক্রিয়াগুলি অনুসরণ করা হয় না।“
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বাঙালি মুসলমানদের কাছে জমি হারিয়েছে বলে জানিয়েছে এবং বিভিন্ন অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলির তথ্যানুসারে জানা গেছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলির প্রয়োজনে এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য আদিবাসীদের ভূমিতে মারাত্মক পরিবেশগত অবনতির কারণ হয়েছে, যার দরুন আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের ভূমির ব্যবহারের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। আদিবাসীদের ভূমি ভয়ংকরভাবে জবরদখল করা হচ্ছে। তারই প্রতিবাদ করতে গেলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড গত আগস্ট মাসে বান্দরবানের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। মূলত সেই ১১ জন গ্রামবাসী তাদের ৪০০ একর কৃষিজমি এবং গ্রামীণ বন রক্ষার দাবি করেছিল।
এছাড়াও বাঙালি প্রতিবেশী ও নিরাপত্তা সদস্যদের কর্তৃক আদিবাসী নারী ও শিশুদের উপর যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলি এখনও অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির অধীনে সংঘটিত আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় লিপ্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মৃত্যু ও সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা অমীমাংসিত অবস্থায় রয়ে গেছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এবং আদিবাসী ব্যক্তিরা সতর্কতা দিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্তঃদলীয় সহিংসতা তীব্রভাবে বেড়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর উল্লেখ করেছে।