হিল ভয়েস, ২৯ মার্চ ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ৭ নং ইউনিয়নে অবস্থিত একটি খাসি গ্রাম কাঁকড়াছড়া পুঞ্জি। খাসি’রা গ্রামকে পুঞ্জি বলেই চেনে। পুঞ্জির খাসি ও গারো আদিবাসী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে এই পুঞ্জির গোড়াপত্তন ব্রিটিশ আমলের। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান আমলে করা স্টেট একুইজিশন সার্ভের খতিয়ানেও এ কথা জানা যায়। তখন পুঞ্জিতে অর্ধশ’তের কাছাকাছি আদিবাসী পরিবার ছিল বলে জানান স্থানীয় পুঞ্জির আদিবাসীরা। পাকিস্তান আমলেই উক্ত এলাকায় পুঞ্জি ঘেষে গড়ে উঠতে থাকে চা বাগান। রেহানা চা-বাগান তার মধ্যে একটি।
সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের চা বাগান ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নির্দেশনায় বলা আছে যে, দেশের অধিকাংশ চা বাগান ১৯৫০ সালের পূর্বে জমিদারি, রায়তি ও প্রজা সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ত্বা আইনের ২০(২) ধারায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সর্বোচ্চ সীমা ৩৭৫ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। উক্ত আইনের ২০(৪এ) ধারায় নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত জমি রাখার এবং ২০(৪বি) ধারায় দীর্ঘমেয়াদি ইজারা প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু চা চাষ উপযোগী জমি ইজারা প্রদানের জন্য কোনো নির্দেশিকা না থাকায় বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে চা বাগান ইজারা প্রদান করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলার চা চাষ উপযোগী প্রচুর ‘খাস জমি’ আছে বলেও নির্দেশনায় বলা হয় ।
এদিকে চা বাগানগুলোর ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে খাসি ও গারো আদিবাসীরা ক্রমাগত তাদের জমি হারাচ্ছেন এবং বাস্তুভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন। ফলে জমি হারাতে হারাতে কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির অর্ধশত পরিবারের মধ্যে বর্তমানে এখন টিকে আছে মাত্র ২১ টি পরিবার। এদিকে গত বুধবার (২২ মার্চ) আগামী ২ এপ্রিল ‘তালপত্র রবিবার’ পালনের জন্য কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির খাসি আদিবাসীরা চা বাগানের ভেতর দিয়ে অবস্থিত তাঁদের দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত রাস্তাটি নিজেদের উদ্যোগে সংস্কারের উদোগ নিলে রেহানা চা বাগান কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে উত্তেজনা তৈরী হয় এবং সেদিন রাতেই রাস্তার মধ্যে ‘বড় বড় গর্ত খনন করে’ রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায় চা বাগান কর্তৃপক্ষ। এমনকি উক্ত রাস্তায় এখন নতুন ‘চা চারা’ রোপন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করে উক্ত পুঞ্জির খাসি ও গারো আদিবাসীরা।
একথার সত্যতা মেলে কাঁকড়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা উত্তমা রেমা’র সাথে কথা বলে। মুঠোআলাপে তিনি বলেন, আমাদের রাস্তা এখন ছোট হয়ে গেছে। চলাচলেও কষ্ট হচ্ছে এবং আমরা এখন অসহায়।
এ নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় গির্জার মন্ডলী পরিচালক মিন্টু রেমা আইপিনিউজকে বলেন, গত ২০২১ সালের মে মাসেও চা বাগান কর্তৃপক্ষ আমাদের পান জুমের পান গাছ এবং বড় বড় অনেক গাছ কর্তন করেছে। বড় বড় গাছ কর্তন পরিবেশের জন্যও ক্ষতি। এবার আমাদেরকে হামলা করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং ছড়া পারাপারের জন্য ব্যবহৃত বাঁশের সাঁকোটিও ভেঙ্গে দিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। এতে আমাদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। এসব কিছুই করা হচ্ছে আমাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য।
মিন্টু রেমা আইপিনিউজকে আরো বলেন, রেহানা চা বাগান শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই কাঁকড়াছড়া পুঞ্জি শুরু হয়। ব্রিটিশ আমলেই আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই পুঞ্জি করেছিল। আগে আমাদের বাপ-দাদারা তেমন কোনো শিক্ষিত ছিলেন না। ফলে অনেক অসচেতনতার কারণে আমাদের বাস্তুভূমি হারিয়েছি। এখন চলাচলের রাস্তাটিও হারাতে হচ্ছে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও স্থানীয় আদিবাসীদের সংগঠন কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং বলেন, আপাতত পরিস্থিতি শান্ত রাখার জন্য ইউএনও সাহেব এসি ল্যান্ডকে পাঠিয়েছেন এবং আমাদের পুরনো ব্যবহৃত রাস্তাটিতে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছেন এবং দু’ পক্ষকেই শান্ত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা আপাতত প্রশাসনের দিকেই তাকিয়ে আছি।
এদিকে রেহানা চা বাগানের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ আইপিনিউজকে বলেন, আমি যতদূর জানি চা বাগানের মালিক পক্ষ মানবতার খাতিরে কিছু খাসিয়াকে বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাগানের ভেতর জায়গা দিয়েছিল। কিন্তু তারা এক ঘর দুই ঘর করে বাড়তে থাকে এবং তারা বাগানের জায়গা’র মধ্যেই অবস্থান করছে। দু’একদিন আগে আমাদেরকে না জানিয়ে তারা কিছু চারাগাছ উপড়ে ফেলেছিল এবং রাস্তা কাটছিল। পরে আমাদের শ্রমিকদের সাথে হাতাহাতিও হয়েছিল। যাইহোক পরে পুলিশকে খবর দিই আমি এবং এসিল্যান্ড সাহেব আসেন। আমরা এসিল্যান্ডের সমঝোতা মেনে চলছি আপাতত। তবে খাসি ও গারোদের কোনো ‘দলিল’ নেই।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, চা-বাগানগুলোর সাথে খাসি আদিবাসীদের ভূমি সম্পর্কিত দ্বন্ধ দীর্ঘদিনের। চা-বাগানগুলো মূলত সরকারী সম্পত্তি এবং নির্ধারিত শর্তে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু ইজারা দেওয়ার সময় কোথাও উল্লেখ থাকে না যে, সেখানে চা বাগানের পাশাপাশি খাসি ও গারো আদিবাসীদের ভোগ দখলীয় পান জুম, অন্যান্য জমি ও তাঁদের বাড়িঘর আছে। ইজারার মধ্যে আদিবাসীদেরকে নাই করে ফেলা হয়। অন্যদিকে এই ইজারা দেওয়ার সময় লীজকৃত জমির পরিমাপ করা হয় না। চা বাগান কর্তৃপক্ষ যেহেতু প্রভাবশালী এবং সরকারের সাথে তাদের যোগ সাজশ থাকে। ফলে তারা স্থানীয় খাসি ও গারো আদিবাসীদের ভোগ-দখলীয় জমি দখল করে থাকে এবং হয়রানি করে থাকে স্বভাবতই।
এ বিষয়টি সমাধানের জন্য তিনি তিনটি পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, প্রথমত আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনা ও সংস্কৃতিতে ‘খাস’ বলতে কোনো শব্দ নেই এবং ‘দলিল’ এর কোনো ব্যবহার নেই। তাদের দলিল থাকুক বা না থাকুক আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারকে স্কীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, চা-বাগান কর্তৃপক্ষ যেন খাসি ও গারো আদিবাসীদের জমি দখল ও হয়রানি করতে না পারে তার জন্য সরকার চা-বাগানগুলোর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি নোটিশ ইস্যু করতে পারে। তৃতীয়ত, এসবের সমাধানে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে, যে কমিশন এসব বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
এ বিষয়ে এসোশিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আমরা মনে করি এটা খাসি ও গারো আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা। এটাতো হতে পারে না। তাদের কাগজ পত্র আছে কী নেই সেটা অন্য বিষয়। প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থাপনায় যারা শত শত বছর ধরে বসবাস করছে তাদের কারোরই কাগজপত্র নেই। তাই বলে তারা এদেশের নাগরিক না, তা নয়। তাঁদের প্রথাগত ব্যবস্থাগুলোর স্বীকৃতি সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও বাস্তবে বহু ক্ষেত্রেই উল্লেখ আছে। এ বিষয়গুলো সুরাহার জন্য আমরা হাইকোর্টে একটি রিট করার জন্য অপেক্ষায় আছি।