হিল ভয়েস, ৭ মার্চ ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (৮ মার্চ ২০২৩) আন্তজার্তিক নারী দিবস। বিশ্বের দেশে দেশে নারী সমাজের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।
এই দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির উদ্যোগে রাঙ্গামাটিতে র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
রাঙ্গামাটির জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে সকাল ৯ টায় জমায়েত ও সেখান থেকে সকাল ৯:৩০ টায় র্যালি শুরু হবে। এরপর সকাল ১০ টায় ‘নারী পুরুষের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকল্পে ডিজিটাল নীতি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের যথাযথ ব্যবহার ও দক্ষতা অপরিহার্য’ প্রতিপাদ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা।
সভায় সভাপতিত্ব করবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মনি চাকমা এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা। এছাড়া অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবন্দ।
উল্লেখ্য যে, ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে বিশ্বের সংগ্রামী ও সমাজতান্ত্রিক নারীদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা নেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুসারেই ৮ মার্চ তারিখে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের সূত্রপাত ঘটে। মূলত ১৯০৮ সালে নিউইয়র্ক শহরে কাজের অমানবিক অবস্থা ও বৈষম্যমূলক মজুরীর প্রতিবাদে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের স্মরণে এই দিবসটিকে বেছে নেয়া হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের দেশে দেশে অব্যাহতভাবে নারী সমাজের জাগরণ ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘও ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৬ হতে ১৯৮৫ সময়কালকে নারী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস আরও ব্যাপকতা লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী নারী সমাজের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ ও গভীর অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে থাকে।
উল্লেখ্য, সমাজে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক সকল ক্ষেত্রে নারীর উপর চলমান বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামসহ সমাজ প্রগতির আন্দোলনে এই দিনটি স্মরণীয় ও অন্যতম একটি অনুপ্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক দিন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এই নারী দিবস উপস্থিত হয়েছে এমন একটা সময়ে যখন বহিরাগত বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক জুম্ম নারীর উপর একের পর এক হত্যাসহ শারীরিক ও যৌন সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে। পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সেই চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগনের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা আজ সুদূরপরাহত হয়েছে। উপরন্তু শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক একের পর এক চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী পদক্ষেপের ফলে জুম্ম জনগণের মানবাধিকার আজ ভূলুন্ঠিত হয়ে পড়েছে। ফলে চুক্তির পরেও জুম্ম নারীর উপর সহিংসতাসহ সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা ও সহায়তায় জুম্মদের ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, মিথ্যা মামলা, মারধর, জেল, জুলুম, দমন-পীড়ন, যত্রতত্র তল্লাসি, হয়রানি ইত্যাদি মানবাধিকার পরিপন্থী কার্যক্রম নিত্য নৈমিক্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জুম্ম জনগণের জাতীয় ও জন্মভূমির অস্তিত্বই আজ চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
২০২২ সালে অন্তত ১২ জন জুম্ম নারী শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিগত মাত্র এক মাসের মধ্যে বাঙালি দুর্বৃত্ত কর্তৃক ১ জুম্ম নারী হত্যা, ২ জুম্ম নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও পাচারের চেষ্টা এবং ১ জন গৃহবধু ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৫ মার্চ ২০২৩ রাতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন সদর উপজেলার বন্দুকভাঙা ইউনিয়নের বাসিন্দা চম্পা চাকমা এক জুম্ম নারী বেসরকারী সংস্থার (এনজিও) পদক্ষেপ এর কর্মকর্তা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এলাকায় মোঃ এনামুল হক এনাম (২৬) নামের এক দূর্বৃত্ত কর্তৃক নৃশংসভাবে খুনের শিকার হন।
গত ৩ মার্চ ২০২৩ সকাল আনুমানিক ১১ টার দিকে রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নে রাঙ্গামাটি-জুরাছড়ি জলপথে ‘স্বাগতম জুরাছড়ি’ নামক স্থানের নিকটবর্তী সুবলং ইউনিয়নের মাইচছড়ি গ্রামে এক আদিবাসী চাকমা গৃহবধু (২৫) নিজ বাড়িতে আবদুল মালেক (৫৫), পীং-বাচা মিয়া নামের এক মুসলিম বাঙালি বোট চালক কর্তৃক ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার দুপুরের দিকে বান্দরবান জেলার লামার ফাঁসিয়াখালিতে এক মারমা নারী (২৪) বাড়ির পাশের ক্ষেতে শাক সংগ্রহ করতে গেলে এসময় মোঃ কায়সার (৩৬), পীং-আবদুল্লাহ নামে এক সেটেলার বাঙালি শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক জুম্ম স্কুলছাত্রীকে (১৪) তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটে। পরে জনি বড়ুয়া ও কাজল বড়ুয়া এবং মোঃ সাকিব ও তার সহযোগী কর্তৃক ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ওই স্কুলছাত্রীকে আটক রেখে একের পর এক গণধর্ষণ এবং অন্যত্র পাচারের চেষ্টার ঘটনা ঘটে।
উল্লেখ্য, উক্ত সহিংস ঘটনার মধ্যে লামার ফাঁসিয়াখালির মারমা নারী ধর্ষণকারী কায়সারকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেলেও অন্যান্য অভিযুক্ত দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করার কথা জানা যায়নি।