হিল ভয়েস, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, চট্টগ্রাম: আজ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, সকল জাতিসত্তার ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয় (চবি) শাখা ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানববন্ধনে বক্তারা দেশের সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার দাবিও জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে অনুষ্ঠিত উক্ত মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চবি সংসদের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক এবং সঞ্চালনা করেন ছাত্র ইউনিয়নের চবি সংসদের শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক সুদীপ্ত চাকমা। এছাড়াও মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পিসিপির চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নরেশ চাকমা ও সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তর চাকমা প্রমুখ। মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চবি সংসদের সভাপতি বলেন, ‘আজকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের, যারা মাতৃভাষাকে বুকে আগলে রেখে আজ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছেন এবং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া সেই ভাষা যোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আজকের এই দিনটি বিশ্বে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পেছনে কেবল ভাষার অধিকার জড়িত ছিল না একইসাথে এই ভূখণ্ডে বসবাসরত জনগোষ্ঠীসমূহের রুটিরুজির অধিকারও সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের পর আমরা মুহূর্তে মুহূর্তে স্বাধীনতার কথা শুনতে পেলেও এখানে বসবাসরত অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা-সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের সংকটের দিকে রাষ্ট্রের নজর দেখতে পাই না। তাদের প্রতিনিয়ত আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি মানুষ নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারলে, নিজের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে এখানে সত্যিকার অর্থে কতটুকু রাষ্ট্রের সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা পায়! বাংলাদেশে বসবাসরত যেসকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো রয়েছে তাদের ভাষার অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকারসহ নাগরিক হিসেবে বাস করার সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে।’
পিসিপির চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক নরেশ চাকমা বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের মূলমন্ত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে পাই না। যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে চর্চার সুযোগ থাকার কথা। কিন্তু আজকে আমরা সেটা দেখতে পাই না। এই রাষ্ট্র আদিবাসীদের নানা আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাঙালির পাশাপাশি এই দেশে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার আজ এই রাষ্ট্র যথাযথভাবে দিতে পারছে না। সমতলের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, প্রশাসনের লোকজন আদিবাসীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামেও রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, সাংস্কৃতিক ও ভাষা চর্চার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মানুষের নিজ ভাষায় কথা বলার, নিজ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করার সংস্কৃতি বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যায্য অধিকারগুলো আমরা এখন পাচ্ছি না।’
পিসিপির চবি শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তর চাকমা বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি বহু ভাষাভাষির রাষ্ট্র। এখানে বাঙালির পাশাপাশি পঞ্চাশের অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা স্ব স্ব স্বাতন্ত্র্যতাকে ধরে রেখে এই দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা রক্ষা করছে। কিন্তু এইসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ এই রাষ্ট্র এখনো যথাযথভাবে করে দিতে পারেনি। সরকার এপর্যন্ত পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বই ছাপালেও বাকিগুলো এখনো অনিশ্চয়তার সঙ্গে আছে। তারা নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও কোটা ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের অভাবে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে আছে। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষার সাথে রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার এইসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতির পাশাপাশি মূলধারা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা অতি জরুরী বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের সকল জাতিসত্তার মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক এবং আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষার জন্য সরকার যেন যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে।’
এছাড়া বক্তারা আরও বলেন, মানুষ হিসেবে প্রত্যেক জাতিসত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষায় কথা বলার ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। কিন্তু আজ রাষ্ট্র দেশের ভিন্ন ভাষাভাষি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিচ্ছে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। সেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু আদিবাসীদের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও তারা অতিদ্রুত এই ভাষাগুলো রক্ষায় সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান।