হিল ভয়েস, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের বটতলী এলাকা থেকে মগপার্টির ৫ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সেনাবাহিনী দাবি করেছে।
উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে মগপার্টি হচ্ছে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। নিজেদের মদদপুষ্ট ও লালিত-পালিত সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদেরকে কেন সেনাবাহিনী নিজেরাই গ্রেফতার করলো এ নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, সেনা-মদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসী (জেএসএস এমএন লারমা) গ্রুপ কর্তৃক মানিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি-মাটিরাঙ্গা-গুইমারা এলাকায় সেনাবাহিনীর এজেন্ডা অনুসারে হত্যা-অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়সহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না পারার কারণে গত জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কর্তৃপক্ষ ও মানিকছড়ির ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব কর্তৃক ৭টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ মগপার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে রাজস্থলী থেকে মানিকছড়িতে নিয়ে আসা হয় এবং মানিকছড়ির হাতিমুড়া এলাকায় মোতায়েন করা হয়।
মানিকছড়িতে অবস্থান নেয়ার পর মগপার্টি সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে গিয়ে সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের গড়িয়াছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের সাথে মুখোমুখী হয়। এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্যকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে গত ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ইউপিডিএফ ও মগপার্টি সন্ত্রাসীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত হয় বলে জানা গেছে। এতে মগপার্টি সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে।
পরে মগপার্টির সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীকে না জানিয়ে গোপনে সেই স্থান ত্যাগ করে। তারপর মারমা ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় মগপার্টির সন্ত্রাসীরা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বটতলী এলাকার বাসিন্দা মো: রমজান আলীর বাড়িতে অবস্থান করতে থাকে।
এমতাবস্থায় গতকাল শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে বটতলী এলাকার বাসিন্দা মো: রমজান আলীর বাড়ি থেকে গুইমারা রিজিয়নের অধীন সিন্দুকছড়ি জোনের একদল সেনা মো: রমজান আলীর বাড়ি থেকে রমজান আলীসহ ইউপিডিএফ (গণাতান্ত্রিক) ও মগপার্টির ৮ জন সন্ত্রাসীকে আটক করে নয়া বাজার ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
ধৃত ৮ জনের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের পর সেনাবাহিনী রমজান আলী ও দুইজন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সস্ত্রাসীসহ তিনজনকে ছেড়ে দেয়। অবশিষ্ট ৫ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে গণমাধ্যমের নিকট তুলে ধরে সেনাবাহিনী এবং তাদেরকে মগপার্টির সদস্য হিসেবে দাবি করে।
কথিত মগপার্টি সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার দেখানোর পেছনে সেনাবাহিনীর কী ষড়যন্ত্র রয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে স্থানীয় অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। সেনাবাহিনী নিজেদের উদ্যোগে রাজস্থলী থেকে মগপার্টি সন্ত্রাসীদের এনে আবার কী উদ্দেশ্যে তাদেরকে গ্রেফতার করলো তা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন উদ্রেক করেছে।
অনেকে মনে করেন, ইউপিডিএফের সাথে এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে সংঘাতে জেরে সেনাবাহিনীর অজান্তে ফটিকছড়ির বটতলীতে পালিয়ে যাওয়ার ফলে সেনাবাহিনী মগপার্টি সন্ত্রাসীদের উপর ক্ষেপে গেছে। কেননা এর ফলে সেনাবাহিনী যে উদ্দেশ্যে মগপার্টি সন্ত্রাসীদেরকে মানিকছড়িতে এনে মোতায়েন করেছে, সেনাবাহিনীর সেই উদ্দেশ্য পূরণ হতে পারছে না। সেজন্য সেনাবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারে বলে স্থানীয় অনেকে সন্দেহ করছেন।
অন্যদিকে অনেকে মনে করেন, মগপার্টির সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর প্রোমোশন বাণিজ্যের শিকার হয়েছে। অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসী গ্রেফতার করতে পারলে অভিযানে অংশগ্রহণকারী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের সহজে পদোন্নতি লাভ করে থাকে। তাই প্রোমোশন লাভের কায়েমী স্বার্থে গুইমারা রিজিয়ন ও সিন্ধুকছড়ি জোনের সেনাবাহিনী মগপার্টি সদস্যদেরকে গ্রেফতার করে থাকতে পারে বলে স্থানীয় অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সাড়ে ১২টায় আটককৃত মগপার্টি সন্ত্রাসীদের মানিকছড়ি সেনা ক্যাম্পে আনা হয় এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্রসহ গণমাধ্যমের নিকট তুলে ধরা হয়। তবে রহস্যজনকভাবে মগপার্টি সন্ত্রাসীদের নাম, ঠিকানা ও পরিচয় প্রদান করেনি সেনাবাহিনী। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি সিন্দুকছড়ি জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ পারভেজ মোস্তফা। এ থেকে বুঝা যায়, মগপার্টি সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের পেছনে সেনাবাহিনীর অন্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বা ষড়যন্ত্র রয়েছে।
সেনাবাহিনী গ্রেফতারকৃত মগপার্টি সন্ত্রাসীদের নাম-পরিচয় গোপন রাখলেও স্থানীয় সূত্রে তিনজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন মানিকছড়ির দাজ্যা পাড়ার মৃত আপ্রুসি মারমার ছেলে প্রদীপ মারমা (২৬), ক্যচিং মারমার ছেলে উষাজাই মারমা (১৯) এবং কংক্য মারমার ছেলে চহ্লা মারমা (২৪)। বাকী দুইজনের নাম এখনো পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করা, সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি করে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া, সর্বোপরি সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি দেখিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি জায়েজ করার হীনউদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব মগপার্টিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে আসছে।