হিল ভয়েস, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, রাঙ্গামাটি: আজ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সোমবার, সকাল ১০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটির নিউ মার্কেটের সম্মুখে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% আদিবাসী কোটা চালু করার দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের (এইচডাব্লিউএফ) যৌথ উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক জিকো চাকমার সঞ্চালনায় এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানুচিং মারমার সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সুমন চাকমা, শহর শাখার সভাপতি মিলন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা এবং সভাপতি সুমন মারমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সহ সভাপতি থোয়াইক্যজাই চাক।
স্বাগত বক্তব্যে থোয়াইক্যজাই চাক বলেন, বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের আগ্রাসী জাতাকলে পিষ্ট হয়ে আদিবাসীদের ভাষাসমূহ হারিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবানের রেংমিটচ্য ভাষার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এ ভাষাটিও আগ্রাসনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, বাংলাদেশ বহু ভাষা এবং বহু জাতির দেশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হচ্ছে পৃথিবীর সকল ভাষার সমান মর্যাদা প্রদান এবং বিকাশের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ জন্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০২২-২০২৩ সাল পর্যন্ত “আদিবাসী ভাষা বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কিছু কিছু সভা সেমিনারের আয়োজন থাকলেও আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% আদিবাসী কোটা চালু করার দাবি জানান।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা বলেন, ভাষা কতগুলো কেবল বুলি সর্বস্ব নয়, ভাষা একটি জাতির সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের স্বাক্ষর। ভাষার মর্যাদার জন্য এদেশে আন্দোলন হয়েছে। অথচ এদেশে আদিবাসীদের ভাষা আজ অসংরক্ষিত ও হুমকির মুখে। আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে রাস্তাঘাটে অফিস আদালতে বিভিন্ন জায়গায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত স্বাধীন দেশে আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও স্বীকৃতির জন্য লড়াই করতে হচ্ছে তার জন্য সরকার এবং রাষ্ট্রের লজ্জা হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা সংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। সরকার তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। কিন্তু আদিবাসী শিক্ষার্থীরা আজো মায়ের ভাষায় পড়তে পারছে না, লিখতে পারছে না এবং শিখতে পারছে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন, রাঙ্গামাটি ঘোষণা-১৯৯৮, দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপ্রত্র-২০০৫, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, জাতীয় শিক্ষা আইন-২০১৬, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খন্ডের ৩৩(খ) ধারায় পাহাড়ি শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের বিষয়গুলো থাকলেও আজ অবধি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসীদের পরিচয় এবং জীবনধারা নিয়ে অনেক অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বাঙালি শিক্ষার্থীদের মাঝে আদিবাসীদের নিয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে তা প্রত্যাহার করে স্ব স্ব জাতির বিশেযজ্ঞ নিয়ে যথাযথ ও সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। তাছাড়া বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। তারা নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে পারছে না এবং গুণগত মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নানা বঞ্চনা-নিপীড়ন জয় করে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিচ্ছু পাহাড়ি ছাত্রদের ভর্তির কোটা সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। তা ৫%-এ উন্নীত করতে হবে। ২০০২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক কমিটি কর্তৃক তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও বিভিন্ন উচ্চ প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের নিকট দেয়া কোটা সংক্রান্ত দাবি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মাস। এই রাষ্ট্রে ভাষার জন্য নানান শ্রেণির মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক পর্যায়ে স্ব স্ব ভাষায় শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। একটা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করার জন্য সেই ভাষার লিখিত রূপ না থাকা হতাশার। আদিবাসী ভাষাগুলোকে লিখিত রূপ দেয়ার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ইউনেস্কোর তথ্যমতে প্রতি সাপ্তাহে ১টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি ভাষা হারিয়ে গেলে সে জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সেই হারিয়ে যেতে বসা ভাষা সংরক্ষণ করার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। কিন্তু এই রাষ্ট্র তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতিকে অবহেলা করে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার গ্যাঁড়াকলে আদিবাসীরা তাদের স্ব স্ব ভাষা চর্চা করতে পারছে না।
এছাড়াও তিনি আদিবাসীদের নামের আগে জনাব, বেগম ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, যে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বুনেছিল সেই স্বাধীন রাষ্ট্র কীভাবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি বিলুপ্ত করতে ষড়যন্ত্র করতে পারে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।
সভাপতির বক্তব্যে ম্রানুচিং মারমা, আদিবাসীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ও সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫% আদিবাসী কোটা চালু করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান।