হিল ভয়েস, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় এক রাতেই ১২টি মন্দিরে ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের আটটি, পাড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি ও চাড়োল ইউনিয়নের একটি মন্দিরে ওই ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে স্থানীয় লোকজন মন্দিরের প্রতিমাগুলো ভাঙচুরের ঘটনাটি টের পান। মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর ছাড়াও সনাতনী সম্প্রদায়ের অন্যতম পবিত্র গ্রন্থ গীতাও ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার গুপ্ত।
প্রবীর কুমার গুপ্ত জানান, গত শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতের কোনো এক সময়ে ধনতলা ইউনিয়নের সিন্দুরপিণ্ডি এলাকার আটটি, পাড়িয়া ইউনিয়নের কলেজপাড়া এলাকার তিনটি ও চাড়োল ইউনিয়নের সাহবাজপুর নাথপাড়া এলাকার একটি মন্দিরের ওই ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। বেশির ভাগ প্রতিমাই রাস্তার পাশে স্থাপিত মন্দিরের। সেসব মন্দিরে কালী, সরস্বতী, লক্ষ্মী ও মনসার প্রতিমা ছিল। সেসব প্রতিমার মাথা, হাত, পাসহ বিভিন্ন অংশ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সকালে স্থানীয় লোকজন প্রতিমাগুলো ভাঙা অবস্থায় পেয়ে প্রশাসন ও পুলিশকে খবর দেন। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতেই এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
ধনতলা ইউনিয়নের পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিন্দুরপিন্ডি মন্দির কমিটির সভাপতি জোতিময় সিংহ বলেন, প্রায় অর্ধশত বছর ধরে আমরা মন্দিরে পূজা করে আসছি। কোনো দিন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শনিবার রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আতঙ্কে রয়েছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানাই।
খবর পেয়ে রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বেলা একটার দিকে প্রতিমা ভাঙচুরের স্থানগুলো পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান ও ঠাকুরগাঁওয়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। পুলিশ এ ঘটনায় কাজ করছে। কোনো গোষ্ঠী এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশে এসব মূর্তি ভাঙচুর করেছে কি না, এসব বিষয় মাথায় নিয়ে ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা যাবে।
জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, শান্তি ও সম্প্রীতির জনপদকে যারা অশান্ত করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে, তাদের শিগগিরই আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গিতে এক রাতে ১২ মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কমিশন।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের আটটি, পাড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি ও চাড়োল ইউনিয়নের একটি মন্দিরে এক রাতে ১৪টি প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা, যা মানবাধিকার কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকার। কিছু কুচক্রী মহল দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে প্রতীয়মান, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা না হলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
এদিকে প্রতিমা ভাঙচুরে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ১৫টি জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ফেডারেশন। সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বালিয়াডাঙ্গীতে একরাতে ১২টি প্রতিমা ধ্বংসের ঘটনা যে সুপরিকল্পিত এবং সম্প্রীতি নষ্টে দেশবিরোধী চক্রের কারসাজি তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আমরা শক্ত হাতে এই অপরাধী চক্রের ঘৃণ্য অপৎপরতা দমনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
বিবৃতিদাতা ফেডারেশনগুলো হলো- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, জাতীয় কবিতা পরিষদ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, পথনাটক পরিষদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থা, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, চারুশিল্পী সংসদ, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদ, আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র, অভিনয় শিল্পী সংঘ, গ্রাম থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও শিশু সংগঠন ঐক্যজোট।