৩য় অংশ: আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত চারদফা দাবিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন
মঙ্গল কুমার চাকমা
জুম্ম জনগণের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে শুরু হলো নিয়মাতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জুম্ম জনগণের পক্ষ থেকে তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য এম এন লারমা এবং মং সার্কেলের রাজা মংপ্রুসাইন চৌধুরীর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের এক জুম্ম প্রতিনিধিদল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত চার দফা দাবিনামা পেশ করেন। উক্ত চারদফা দাবি ছিল নিম্নরূপ-
- পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং ইহার একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
- উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষরণের জন্য ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’র ন্যায় অনুরূপ ‘সংবিধি ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
- উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করা হবে।
- পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাইয়ের ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টামের বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ ‘সংবিধি ব্যবস্থা’ শাসনতন্ত্রে থাকবে।
জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের এই দাবিতে বাংলাদেশের নব্য শাসকগোষ্ঠী সাড়া দিতে বিন্দুমাত্র এগিয়ে আসেনি। জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশের মহান সংগ্রামী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুম্ম জনগণ ভেবেছিলেন আশা-ভরসার একমাত্র শেষ স্থল। অথচ তাঁর জাত্যাভিমানী ও দাম্ভিক উক্তিতে জুম্ম নেতৃবৃন্দ যারপরনাই হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করায়, বরং উল্টো বাড়াবাড়ি না করার প্রচ্ছন্ন হুমকি জুম্ম জনগণকে চরম আশাহীন করে তুলে। ফলে আশাভঙ্গের বেদনা, হতাশা ও বঞ্চনায় জুম্ম জনগণ আন্দোলনে ফুঁসে উঠতে থাকে। যত বড় মহান নেতা হোক না কেন, জুম্ম জনগণকে কেউ আপন করে না, ভাবে না বা ভাববে না, তাই জুম্ম জনগণকে নিজেরাই নিজেদের পথ বেছে নিতে হবে এই দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হতে থাকে।
১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে জুম্মদের একটি প্রতিনিধিদল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেসময় প্রতিনিধিদল জুম্ম জনগণের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য এই অঞ্চলের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা প্রদানের দাবি জানান। সেখানেও বঙ্গবন্ধু পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ শাসনতান্ত্রিক মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকার করেন।
এমনিতর পরিস্থিতিতে জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি সংগ্রামের কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। পাহাড়ি ছাত্র সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জুম্ম ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকে এবং বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় নির্যাতন-নিপীড়ন ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করা হয়। তার সমর্থনে ১৯৭২ সালের ৯ই জুন রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির এক ঐতিহাসিক ছাত্রমিছিল বের করা হয়। উক্ত মিছিলে আপামর জুম্ম ছাত্র সমাজ ক্ষোভ, অসন্তোষ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে সফলভাবে জুম্ম ছাত্রদের মিছিল, সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান সম্পন্ন করে।
কিন্তু বার বার দাবি-দাওয়া সত্তে ও বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। এর প্রতিবাদ স্বরূপ পাহাড়ি ছাত্র সমিতিও আরো বেশি সোচ্চার হয়ে জঙ্গীরূপ নিয়ে আন্দোলনে নামে। ১৯৭২ সালে (মতান্তরে ১৯৭৩ সালে) এক নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা ও সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের হীন ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জুম্ম জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আরো জোরালো করার বজ্র কঠোর শপথ গ্রহণ করা হয়। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে জুম্ম ছাত্রসমাজকে সকল সংকীর্ণতা থেকে উর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে আরো ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামী হওয়ার আহ্বান রাখেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত হয়। গণপরিষদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসন কাঠামো এবং জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষাপটে সংবিধানে সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য এম এন লারমা সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট এবং গণপরিষদে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। দফাওয়ারী সংবিধান-বিল বিবেচনাকালে তিনি ২ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে সংবিধানে ৪৭ক অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তির জন্য গণপরিষদে প্রস্তাব তুলে ধরেন যে, “৪৭ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল একটি উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হইবে।” সাংবিধানিক নিশ্চয়তা সংক্রান্ত এম এন লারমার সেই সংশোধনী প্রস্তাব শাসকদলের উগ্র জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতায় শাসকগোষ্ঠী প্রত্যাখ্যাত করেছিল।
বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ একটি ঐতিহাসিক কালো দিন। ঐদিন আওয়ামী লীগের সদস্য আহম্মদ রাজ্জাক ভূঁইয়ার প্রস্তাবিত “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন” সম্বলিত সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার অধিকারী জুম্ম জনগণসহ দেশের প্রায় ৫৪টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সাংবিধানিকভাবে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এম এন লারমার তীব্র প্রতিবাদ সত্তে¡ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেদিন তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের সেই বর্ণবাদী সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এবং ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী জুম্ম জাতিসমূহকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এম এন লারমা সেদিন এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদের অধিবেশন বর্জন করেছিলেন এবং সংবিধানে স্বাক্ষর প্রদান থেকে বিরত থাকেন।
বাংলাদেশের নতুন সংবিধানের আওতায় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনী সমাবশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জুম্মদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমরা এখন সবাই বাঙালি। এখানে কোন উপজাতি নেই। আমি আজ থেকে আপনাদেরকে উপজাতি থেকে বাঙালি জাতিতে প্রোমোশন দিলাম।’ এ কথা বলার সাথে সাথে সমাবেশে বসা জুম্ম ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ক্ষোভে, দু:খে, প্রতিবাদে সমাবেশে অংশগ্রহণকারী জুম্মরা শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য শেষ না হতেই ধীরে ধীরে সমাবেশ স্থল ত্যাগ করে চলে যেতে থাকে। সেদিন জুম্ম জনগণ বুঝেছিল যে, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের শাসকগোষ্ঠীও জুম্ম জনগণের উপর জাতিগত নিপীড়ন চাপিয়ে দিতে উদগ্রীব। সদ্য স্বাধীন দেশের শাসকগোষ্ঠীও চরম জাত্যাভিমানী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক। সেদিন ভাগ্যহত জুম্ম জনগণ বুঝেছিল, সংগ্রাম ছাড়া জুম্ম জনগণের কোন গত্যন্তর নেই। সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের হৃত অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে তার কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের পর সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে এম এন লারমা এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে চাইথোয়াই রোয়াজা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। নির্বাচনের সময় চাইথোয়াই রোয়াজা পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে এলাকায় এলাকায় মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রোসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করেন। সংসদীয় জীবনে তিনি এম এন লারমাকে সর্বদা সমর্থন, সাহস ও সহযোগিতা যুগিয়েছিলেন।
এম এন লারমার সংসদীয় সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের চারদফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংবিধানে জুম্মদেরকে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও ওয়ার্কআউট করা, সংবিধান বিলে স্বাক্ষর না করা ও বাঙালি হিসেবে পরিচয় না দেয়া, সংবিধানে দেশের শোষিত-বঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক-মাঝিমাল্লা-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতী-পতিতাদের মৌলিক অধিকার, স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর গভীর স্বপ্ন ও ভাবনা, দেশরক্ষা ও ডিফেন্স বাজেট, পবিত্র কোরান পাঠের পাশাপাশি গীতা-ত্রিপিটক-বাইবেল পাঠের দাবি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গণপরিষদে ও জাতীয় সংসদে একাই লড়াই করে গেছেন। গণপরিষদ এবং প্রথম জাতীয় সংসদে এম এন লারমার সংসদীয় লড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার-বঞ্চিত জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সুদূর প্রসারী ভূমিকা রেখেছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অঞ্চল হিসেবে বিশেষ শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা তথা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিপরীতে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৭৩ সালে দীঘিনালা, রুমা ও আলিকদমে তিনটি সেনানিবাস স্থাপন করে। রাজাকার দমনের নামে শুরু হয় অধিকারকামী জুম্মদের উপর দমন-পীড়ন। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক সামরিক অভিযান চলতে থাকে। তার বিপরীতে শুরু হয় অধিকারকামী জুম্ম জনগণের জোরালো সর্বাত্মক নিয়মতান্ত্রিক লড়াই। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যাধিক্যে এম এন লারমা এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে চাথোয়াই রোয়াজার জয়লাভে গতি সঞ্চার করলো জুম্ম জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে।
১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে মিলিত হলেন মহান নেতা এম এন লারমাসহ ২২ সদস্যের জুম্ম প্রতিনিধিদল। এই ডেপুটেশনে আবারো পেশ করা হয়েছিল জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য স্বতন্ত্র শাসনব্যবস্থা ও অধিকার সম্বলিত চারদফা দাবিনামা। উক্ত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “লারমা তুমি কি মনে কর। তোমরা আছ ৫/৬ লাখ। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। চুপচাপ করে থাক। বেশি বাড়িবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না। প্রয়োজনে ১, ২, ৩, ৪, ৫, …১০ লাখ বাঙালি ঢুকিয়ে করে তোমাদেরকে উৎখাত করবো, ধ্বংস করবো।” সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান জুম্ম প্রতিনিধিদলের স্মারকলিপিও গ্রহণ করেননি। এমনকি প্রতিনিধিদলকে বসার জন্য সৌজন্যবোধও দেখাননি। উক্ত ডেপুটেশনের পর জুম্ম প্রতিনিধিদল ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ঢাকাস্থ বেইলি রোডে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে আরেকটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকেও মূল দাবি ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের, যা সরকারের প্রতিনিধিদল তীব্র বিরোধিতা করে এবং সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এভাবেই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হতে থাকে।
এম এন লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ দেশের বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী সকল রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে বিস্তারিত ও বহুবার আলোচনা চালিয়েছিলেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে দু’একজন রাজনৈতিক নেতা ব্যতীত কেউ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেননি। তাদের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনালিষ্ট আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী এবং পূর্ব পাকিস্তানের একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে জনসংহতি সমিতিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশিষ্ট প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতৃবর্গ নিজ নিজ দলীয় স্বার্থের গন্ডীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে দেখতেন। অধিকাংশ জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো শুধু চাইতো জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের নিজ নিজ দলীয় শাখা গঠন করতে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল রাজনৈতিক সমস্যাকে বাদ দিয়ে কোন ধরনের রাজনীতি করতে রাজী ছিলেন না।
এমনিতর অবস্থায় কঠোর-কঠিন আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে সমগ্র জুম্ম ছাত্র সমাজ জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। আর জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে চালিয়ে নিতে জুম্ম ছাত্র সমাজ নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে থাকে। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জুম্ম জনগণের প্রাণের দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের সংগ্রাম। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে সীমিত থাকেনি। জুম্ম জনগণকে দেশপ্রেমে ও জাতীয় সংগ্রামে উজ্জীবিত করার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলে। তারই অংশ হিসেবে পাহাড়ি ছাত্র সমিতি শুধু রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও ছাত্র সমাজের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। সেই সাথে জুম্ম ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রেও এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। জুম্ম সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠে ‘গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী’।
অপরদিকে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এক আদেশ বলে দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্তির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ’ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। জাতীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয় যে, ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বাকশালে যোগদান না করে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য পদে বহাল থাকতে পারবেন না।’ ফলে এম এন লারমার পক্ষে বাকশাল যোগ দেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর ছিল না। সেসময় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এম এন লারমাকে আশ্বস্থ করেছিলেন যে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিবেন এবং জুম্ম জনগণের দাবিদাওয়াসমূহ বিবেচনা করবেন। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের স্বার্থে এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অনুকূল অবস্থা বজায় রাখার লক্ষ্যে এম এন লারমা সেদিন বাকশালে যোগদানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাকশাল পদ্ধতি পূর্ণভাবে কার্যকর হওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর বাসভবনে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও ধর-পাকড়, দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক হয়রানি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক কর্মকান্ড, সভা-সমাবেশ এবং বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়। সারাদেশের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনে রূপান্তর করা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। একপর্যায়ে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
(চলবে…..)