জনসংহতি সমিতি সবসময় পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে সচেষ্ট: রাশেদ খান মেনন

হিল ভয়েস, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সবসময় রাজনৈতিক সমাধানে সচেষ্ট ছিল। পাহাড়ে সমস্যার পেছনে জনসংহতি সমিতির দিকে যে আঙ্গুল তোলা হয়, তা সঠিক নয়। এটাও জনসংহতি সমিতির প্রতি একটা অন্যায়।

আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত আলোচনা সভায় এই অভিমত তুলে ধরেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন।

সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা। এছাড়াও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, লেখক ও সাংবাদিক আবু সাইদ খান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো এছাড়া স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা। সংহতি বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা প্রমুখ।

রাশেদ খান মেনন বলেন, যারা এই দলটি গঠন করেছিল তারা আজ বয়সের ভারে নুহ্য। রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সৃষ্টি। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই পাহাড়ের তৎকালীন তরুণরা সংগঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে তারা। এই দলটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করেছে যে, বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন আপরাপর আদিবাসীদের স্বীকৃতি চেয়েছেন। এবং সেটা অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে নয়। তারা সংবিধানের আওতার মধ্য দিয়েই এই স্বীকৃতি চেয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, জনসংহতি সমিতি চুক্তির স্বাক্ষরের পর ২৫ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের আশা করছে। এটাও তাদের রাজনৈতিক সমাধান খোঁজারই পন্থা। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একটি প্রাগ্রসর রাজনৈতিব দল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে জাতীয় দল হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।

জনসংহতি সমিতির লড়াই একার নয়, আমাদের সবার লড়াই দাবি করে সাম্প্রতিক সময়ের কুকি-চিন প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন আরো বলেন, সামরিক প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে কেএনএফ নামের সংগঠনটি ইসলামী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেন হঠাৎ র‌্যাব, সামরিক বাহিনী এবিষয়ে সচেতন হয়ে উঠল। তাহলে আগে নাইক্ষংছড়িতে পাওয়া অস্ত্রের উৎস কোথায় বলে প্রশ্ন রাখেন মেনন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি আত্মনিবেদিত রাজনৈতিক সংগঠন। এ দেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যেসমস্ত বিষয়াবলী জাতীয় জীবনে এবং গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই দলটি। আমরা যখন সংবিধান প্রনয়নের কাজে হাত দিলাম তখনই আমরা দেখলাম, আমরা জাতীয়তাবাদের আতিশয্যে এমন একটা পদক্ষেপ নিলাম, যে পদক্ষেপ আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সংবিধানে বলা হলো এ দেশের জনগণ জাতিতে বাঙালি। এ দেশটা শুধু বাঙালির নয়, বাঙালির বাইরে আরও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্যও। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাঙালি শাসকশ্রেণীর কর্তৃত্ব এখনও শেষ হচ্ছে না। জনসংহতি সমিতিকে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসাবে ঘোষণারও আহ্বান জানান এই আদিবাসী গবেষক।

লেখক ও সাংবাদিক আবু সাইদ খান বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, সে লড়াইয়ের একপর্যায়ে আদিবাসীরাও যুক্ত হয়েছিল। সঙ্গত কারণে সে লড়াইটা বাঙালির জাতীয়তাবাদের আন্দোলন ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যারা সামিল হয়েছিলো তাদের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে দাবিগুলোকে নিয়ে জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়েছিল সেটার প্রথম সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামলীগ। কিন্তু সেটাকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা যে সাধুবাদটা দিয়েছি সেটা এখন ধরে রাখা যাচ্ছে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বিশিষ্ট এই সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা।

কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমাদের দেশের প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে জনসংহতি সমিতি পৃথক। জনসংহতি সমিতি নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল। তারা যে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করেছে, এবং কি সংকটের মধ্যে এখনও লড়াই করছে- এটা আমরা কমবেশি জানি। তাঁদের এই সংগ্রাম একটি ভিন্ন মাত্রার সংগ্রাম। তাদের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর জন্য একেবারেই সরাসরি রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে যেন তারা ঠিকমত দাঁড়াতে না পারে, এটা একটা বড় সংকট। তার মধ্যেও তারা যে কার্যক্রম ও লক্ষ্য অর্জনে তারা তাদের ভূমিকা পালন করবে তা আমি প্রত্যাশা করছি। এ লড়াই শুধু জুম্ম জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত না, এ লড়াই আমাদের দেশের অগ্রগতির সাথে জড়িত। এ লড়াই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথেও জড়িত।

ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ শত শত বৎসর যাবত লড়াই-সংগ্রাম করছে। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে আদিবাসী শব্দটি স্থান পায়নি। আদিবাসীদের যে লড়াই সংগ্রাম শুধূ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়, সমতলের যে আদিবাসীরা লড়াই করছে সেই স্বীকৃতি তারা পায়নি। সেই স্বীকৃতি আদায় করার জন্যে তাদের শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৯৭২ সালে তারা জনসংহতি সমিতি গঠন করে।

সভাপতির বক্তব্যে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমরা যুদ্ধ চাইনি। রাষ্ট্র আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি। সামরিক কর্তৃত্ব যখন রণক্লান্ত এবং বুঝলেন যে, পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে তখনই সরকার আমাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়াই করিনি। বাংলাদেশের সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই আমরা পার্বত্য চুক্তি করেছি। সেই চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাই।

উল্লেখ্য, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের অধিকারকামী ও সমাজের প্রগতিকামী অংশের উদ্যোগে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটিতে গঠন করা হয় এই জনসংহতি সমিতি। গঠনের পর প্রথমে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করে। এরপর ১৯৭৫ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হলে আড়াই দশক ধরে সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনা করে। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে দুর্বার সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

More From Author