হিল ভয়েস, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: আগামীকাল (১৫ ফেব্রুয়ারি) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ রাজনৈতিক পার্টি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। যে পার্টির নেতৃত্বে শুরু হয় জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। যে পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত হয় বিশ্বের আদিবাসীদের অন্যতম লড়াকু গেরিলা বাহিনী ‘শান্তিবাহিনী’। যে পার্টির নেতৃত্বে জন্ম হয় প্রগতিশীল ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’।
জনসংহতি সমিতির সুবর্ণ জয়ন্তী ও ৫১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগামীকাল রাঙামাটি জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় এবং ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। অপরদিকে এই উপলক্ষে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বিকাল ২:০০ টায় চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদারের সভাপতিত্বে একটি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
আগামীকাল (১৫ ফেব্রুয়ারি), বিকাল ৩:০০ টায়, ঢাকার বাংলামটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে এক আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা। এতে অতিথি আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, লেখক ও সাংবাদিক আবু সাইদ খান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন্স হোসেন প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, বাংলাদেশ জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক গজেন্দ্র নাথ মাহাতো প্রমুখ।
উল্লেখ্য, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের অধিকারকামী ও সমাজের প্রগতিকামী অংশের উদ্যোগে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটিতে গঠন করা হয় এই জনসংহতি সমিতি।
গঠনের পর পরই জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষার স্বার্থে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের নিকট নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্তশাসনসহ চার দফা দাবিনামা তুলে ধরে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জনসংহতি সমিতির এ দাবি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এতে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের মধ্যে গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতের সংগ্রামের দূর্গম পদযাত্রা হিসেব করে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি গঠন করা হয় জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা, যার নাম ক্রমে হয়ে ওঠে ‘শান্তিবাহিনী’।
তারপরও জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের নেতা এবং সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে ও সংসদের বাইরে গণতান্ত্রিকভাবে জনসংহতি সমিতির উক্ত দাবির স্বপক্ষে নিরলসভাবে আন্দোলন চালিয়ে যান এবং দেনদরবার করেন। অপরদিকে, শান্তিবাহিনী গঠিত হলেও সাথে সাথে সরকারি বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়নি। বস্তুত প্রথমদিকে সমাজের মধ্যকার চোর, ডাকাত ও সমাজবিরোধী অপরাধীদের দমন করার কাজেই নিয়োজিত হয় এই বাহিনী। সেইসব অপরাধীদের কার্যক্রম দমন করে এলাকায় এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলে জনগণই এর নাম দেয় শান্তিবাহিনী।
পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক শাসনের অমানিশা নেমে আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে এর পরপরই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও তাঁর সহোদর জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি আত্মগোপনে যেতে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংহতি সমিতি ও এর শান্তিবাহিনী একটি জনপ্রিয়, শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল দল ও গেলিরা বাহিনী হিসেবে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে, তেমনি বহির্বিশ্বে স্বীকৃতি ও পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দূরদর্শী ও সুদক্ষ পরিচালনায় ও নির্দেশনায় জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলন এবং দেশে-বিদেশে প্রচার আন্দোলন ক্রমাগত এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক এমনই মুহূর্তে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের অপরিণামদর্শী, ষড়যন্ত্রমূলক ও বিশ্বসঘাকতামূলক এক আক্রমণে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ৮ সহযোদ্ধাসহ নিহত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। নেতার মৃত্যুতে আন্দোলনে সৃষ্টি হয় বিরাট বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ও অপূরণীয় ক্ষতি। বস্তুত এটা ছিলো জুম্ম জাতির অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনে অনিবার্য বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে বিশ্বসঘাকতামূলক এক আঘাত।
কিন্তু জনসংহতি সমিতির অন্যতম কান্ডারী, আপোষহীন বিপ্লবী ও জীবন্ত কিংবদন্তী গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার দূরদর্শী নেতৃত্বে ও বিচক্ষণ পরিচালনায় পার্টি তথা শান্তিবাহিনী অচিরেই সুসংঠিত ও সুসংহত হয়ে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রকে হটিয়ে দেয় এবং জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হতে সক্ষম হয়।
জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বেই অনেক ষড়যন্ত্র ও চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে প্রায় দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে জনসংহতি সমিতি ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। কিন্তু বিগত ২৫ বছরে সরকার পার্বত্য চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও মৌলিক বিষয়সমূহ পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। এক নাগাড়ে ১৪ বছর ধরে এই সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। উপরন্তু সরকার চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে বলে জনসংহতি সমিতির অভিযোগ।
জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, সরকার বর্তমানে শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে সামরিক উপায়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে চলেছে এবং জুম্ম জগণগণকে জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় জনসংহতি সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।