হিল ভয়েস, ২ জানুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: ভূমিদস্যু ও লিজ কোম্পানী ‘লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ কর্তৃক বান্দরবান জেলার লামা উপেজলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন কার্বারী পাড়ায় আবার অগ্নিসংযোগ ও হামলা করেছে। এতে রেংয়েন কার্বারী পাড়ার ম্রো গ্রামবাসীর ৭টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মিভূত হয়েছে এবং ২টি বাড়ি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, আজ সোমবার (২ জানুয়ারি) রাত ১:০০ ঘটিকায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্বরত দেলোয়ার, নুরু ও মহসিনের নেতৃত্বে রাবার বাগানের শ্রমিক ও ৪ ট্রাক বহিরাগত ভাড়াটে লোকসহ প্রায় ১৫০ জনের অধিক বহিরাগত লোক মিলিত হয়ে সরই ইউনিয়নের রেংয়েন কার্বারী পাড়ার ম্রো গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এতে রেংয়েন কার্বারী পাড়ার চামরুম ম্রো, সিংচ্যং ম্রো, লাংনক ম্রো ও রিংইয়ং ম্রোসহ ম্রো গ্রামবাসীদের ৭টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং রেংইয়ুঙ ম্রো ও দুইঠ্যাঙ ম্রো-এর বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়া হয়। এছাড়া হামলাকারীরা ম্রো গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ৩টি মোবাইল লুট, মুরগী, ছাগল ইত্যাদি লুট করে নিয়ে যায়।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে এযাবত ১১ বার হামলা:
উল্লেখ্য যে, গত ২৬ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার আদিবাসীদের ৩৫০ একর জুম ভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীন বনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এতে লামার তিন গ্রামে জুম্মদের ৩৫০ একরের জুমভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীণ বনে অগ্নিসংযোগের ফলে ৩৯ পরিবারের ২০০ জন গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকা, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকটের মুখে পড়েছে, অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুসহ প্রাকৃতিক প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ভূমিদস্যু লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের অগ্নিসংযোগ, হামলা ও ষড়যন্ত্রমূলক অপকর্ম এখানেই থেমে থাকেনি। ২৬ এপ্রিল ২০২২ হামলার পর ২০২২ সালে আরো কমপক্ষে ১১ বার হামলা এবং ২টি ষড়যন্ত্রমূলক সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। নিম্নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ-এর এসব হামলা ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড উল্লেখ করা গেল-
১। ১৩ জুলাই লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের কামাল উদ্দিন, মোয়াজ্জেম হোসেন, উহির উদ্দিনের গ্যাং ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক, রংধজন ত্রিপুরা, ডলুছড়ি হেডম্যানের অফিসে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে আক্রমণ করে।
২। ১০ আগস্ট রাবার কোম্পানির ভাড়াটে লোকজন রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়।
৩। ১৪ আগস্ট ডেপুটি ম্যানেজার আব্দুল মালেক লামা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরাসহ ১১ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করেন।
৪। ১ সেপ্টেম্বর ভূমিদস্যুরা লাংকম পাড়ায় ম্রোদের মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেত থেকে ২৫ মণের অধিক মিষ্টি কুমড়া লুট করে।
৫। ৪ সেপ্টেম্বর লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর ডেপুটি ম্যানেজার আব্দুল মালেক কর্তৃক ভূমি রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত রংধজন ত্রিপুরা, লংকম ম্রোসহ ১৪ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মিথ্যা মামলা (সিআর মামলা নং-৩১৩/২০২২) দায়ের করা হয়।
৬। ৬ সেপ্টেম্বর রাবার কোম্পানির শ্রমিকরা রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়াবাসীদের পানির উৎস কলাইয়া ঝিরিতে বিষ ঢেলে দিয়ে পাড়াবাসীদের হত্যার চেষ্টা চালায়।
৭। ২৪ সেপ্টেম্বর রাবার কোম্পানির লোকজন রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার বাসিন্দা রেংইয়ুং ম্রোর প্রায় ৩০০ কলা গাছ কেটে দেয়।
৮। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ লামা থানার এসআই শামীম স্কুল নির্মাণ কাজে নিয়োজিত গ্রামবাসীদের নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।
৯। ২৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন ও পুলিশ উক্ত জায়গায় রাবার কোম্পানি ও গ্রামবাসীদের বিরোধের জের ধরে উভয় পক্ষকে প্রবেশে ১৪৪/৪৫ ধারা মোতাবেক নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এবং হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গত ২ অক্টোবর রাবার কোম্পানির লোকজন উক্ত স্থানে জঙ্গল কাটে।
১০। ২৩ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন ম্রো গ্রামবাসীদের ৭০টি আমগাছ এবং আনুমানিক ২০ একর পরিমাণ গ্রামের বন কেটে দেয়।
১১। ২ জানুয়ারি ২০২৩ রেংয়েন কার্বারী পাড়ার ম্রো গ্রামবাসীর ৭টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মিভূত এবং ২টি বাড়ি ভেঙ্গে দেয়া হয়।
ভূমিদস্যু লামা রাবার কোম্পানীর প্রেক্ষাপট:
আশি-নব্বই দশকে রাবার প্লান্টেশন, বন বাগান, ফলবাগানসহ হর্টিকালচারের নামে বান্দরবান পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তির নিকট প্রদত্ত ৪০ বছর মেয়াদী ভূমি লীজ দেয়া হয়। বান্দরবান সদর, লামা, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় সমতল জেলার (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগ) অধিবাসীদের নিকট সর্বমোট ১৬০৫টি রাবার প্লট ও হর্টিকালচার প্লট-এর বিপরীতে প্লটপ্রতি পঁচিশ একর করে ৪০,০৭৭ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে।
লীজ গ্রহণকারীদের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠী রয়েছে। লীজ প্রদত্ত ভূমির মধ্যে রয়েছে আদিবাসী জুমচাষীদের প্রথাগত জুমভূমি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদলীয় ভূমিও রয়েছে। এর ফলে শত শত জুম্ম অধিবাসী তাদের জুম ক্ষেত্র হারিয়ে ফেলছে এবং নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে।
এ ধরনের অন্যতম প্রকল্পের উদাহরণ হচ্ছে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ৬৪ জন সামরিক-বেসামরিক আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিকট প্রদত্ত লিজ, যারা লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি রাবার কোম্পানী গঠন করেছে।
লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকদের মধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আল হোসেনী, সাবেক মুখ্য সচিব কে এম রাব্বানী, সাবেক সচিব কামালউদ্দিন, ডা: মোহাম্মদ ফরিদের স্ত্রী, কে এম রাব্বানীর ছোট ভাই ক্যাপ্টেন (অব:) হাবিবী রাব্বানী, রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি রফিকুল করিম এবং তার পরিবারের চারজনসহ মোট ৬৪ জন সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হয়েছেন।
৬৪ জন ইজারাদারকে প্রতি প্লটে ২৫ একর করে ৬৪টি প্লটে ১,৬০০ একর জমি লিজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু লামা রাবার কোম্পানী রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ১,৬০০ একরের স্থলে তিনটি জুম্ম গ্রামের জুম ভূমি, মৌজা ভূমিও গ্রামীন বনসহ প্রায় ৩,৫০০ একর ভূমি জবরদখল করেছে। এতে তিন গ্রামের ৩৯ পরিবারের জীবন-জীবিকা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পার্বত্য চুক্তিতে এসব লিজ বাতিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় লিজ হোন্ডাররা অবৈধভাবে ভূমি বেদখল করে চলেছে।