হিল ভয়েস, ৬ জানুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চার সদস্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তদল বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ঢেঁকিছড়া আমবাগান এলাকায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের শিকার রেংয়েন ম্রো পাড়া পরিদর্শন করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সকাল ১০:৩০ টায় বান্দরবান জেলা শহর থেকে তদন্তটিম সরেজমিনে তদন্তের জন্য রেংয়েনপাড়ায় পৌঁছান।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তদলে রয়েছেন কমিশনের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সদস্য কংজরী চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) মো: আশরাফুল আলম (জেলা ও দায়রা জজ), উপ-পরিচালক মোহাম্মদ গাজী সালাউদ্দিন এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: রবিউল ইসলাম।
মানবাধিকার কমিশনের তদন্তদল ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ শহীদুল ইসলাম চৌধুরী, সরই ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস কোম্পানি, বান্দরবান জেলা ও লামা উপজেলার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটির সদস্যরা ম্রোদের পোড়া ভিটা ও ভাঙচুর হওয়া ঘরবাড়ি ঘুরে দেখেন। তাঁদের পেয়ে হামলায় ঘরহারা ম্রো গ্রামবাসীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পাড়ার কার্বারি রেংয়েন ম্রো বলেন, তাঁদের উচ্ছেদ করে জমি দখলের জন্য ১ জানুয়ারি গভীর রাতে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড কোম্পানি লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।
ঘর পুড়ে যাওয়া বিধবা নারী চামরুম ম্রো তদন্ত কমিটিকে বলেন, হামলাকারীরা ট্রাকে করে চিৎকার করতে করতে গ্রামে এসে হামলা করে। আওয়াজ শুনে তিনি দুই শিশুসন্তানসহ কোনোরকমে জঙ্গলে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।
পরিদর্শন শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত শাখার পরিচালক আশরাফুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, লামার সরইয়ে গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া ভূমি বিরোধের প্রথম থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় প্রশাসন ও পুলিশকে কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনা মানলে আবার হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটত না।
তদন্ত কমিটির প্রধান কংজরী চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না উল্লেখ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা ভূমি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সঠিকভাবে কাজ করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। ভূমি কমিশন সভা ডাকলেই এক পক্ষ হরতালের ডাক দেয়।
উল্লেখ্য যে, গত ২৬ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার আদিবাসীদের ৩৫০ একর জুম ভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীন বনে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এতে লামার তিন গ্রামে জুম্মদের ৩৫০ একরের জুমভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীণ বনে অগ্নিসংযোগের ফলে ৩৯ পরিবারের ২০০ জন গ্রামবাসীর জীবন-জীবিকা, খাদ্য ও পানীয় জলের সংকটের মুখে পড়েছে, অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর মৃত্যুসহ প্রাকৃতিক প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটে চললেও আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের জীবন ও বসতবাড়ির নিরাপত্তা পাচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা সম্ভব না।
বিচারহীনতার বিদ্যমান সংস্কৃতিই এই অপরাধীদের আদিবাসীদের উপর বারবার আক্রমণ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
অগ্নিসংযোগ ও হামলার আগের দিন সন্ধ্যায় লামা থানার এস আই শামীম এসে রেংয়েন ম্রো পাড়াবাসীদের শাসিয়ে যায়, এই এলাকায় বাড়ি ঘর করা যাবে না। সব ভেঙ্গে ফেলা হবে। পুলিশের এই বক্তব্যর পরই রাতে রাবার কোম্পানীর লোকজন হামলা চালায়। তাই আদিবাসীরা এতো অসহায়ত্বের মধ্যে থেকেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে।
প্রায় একবছর ধরে লামা রাবার কোম্পানীর যোগসাজশে পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে লামার এই আদিবাসীদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা অমানবিক ও বর্বরোচিত বলে উল্লেখ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
ম্রো ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান সহিংস ঘটনার ন্যায়বিচার, জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের ভূমির অধিকারসহ জীবনের নিরাপত্তা বিধান এবং লামা রাবার কোম্পানির লিজ বাতিলের দাবি করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ৪২ জন বিশিস্ট নাগরিক সহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ।