হিল ভয়েস, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া নতুন ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দুই সদস্য কেএনএফের আস্তানায় মারা গেছে বলে জানা গেছে।
নিহত দুই জঙ্গীর মধ্যে একজন হলো ইসলামী উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে যাওয়া কুমিল্লার সাত তরুণের একজন মো: আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন (২৩)। সে বান্দরবানের রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় মারা গেছে বলে জানা গেছে।
ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল নামে এক জঙ্গী সদস্য ধরা পড়ার পর র্যাবের কাছে আল আমিনের মৃত্যুর তথ্য জানায় শিখিল।
জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবের কাছে শিথিল জানায় যে, আল আমিন অভুক্ত থেকে অসুস্থ হয়ে গত ২৫ নভেম্বর ২০২২ তারিখে মারা যায়। এরপর তাকে কম্বল পেঁচিয়ে কবর খুঁড়ে বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউপির ৬নং ওয়ার্ডের দূর্গম লুয়াংমুয়াল পাড়ায় দাফন করা হয়।
তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে গত রবিবার (১৫ জানুয়ারি) প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের লুয়াংমুয়াল পাড়ায় অভিযান চালায়। সঙ্গে আল আমিনের বাবা মো: নুরুল ইসলামকেও নেওয়া হয়।
রবিবার বান্দরবান থেকে হেলিকপ্টারে করে রুমা উপজেলায় নেয়া হয় মো: নুরুল ইসলামকে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গহিন অরণ্যে যেখানে আল আমিনের কবর সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মামুন শিবলীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা ছিলেন।
গ্রেপ্তারকৃত ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিলকেও তাদের সাথে নেওয়া হয়। সে আল আমিনের কবর দেখিয়ে দেয়। কিন্তু কবর খুঁড়ে লাশ পাওয়া যায়নি, কেবল একটি কম্বল ও কাপড় পাওয়া গেছে। তবে কবরের আশপাশে কিছু স্যান্ডেল, জামাকাপড় ও হাঁড়িপাতিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল।
ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে কেএনএফের সদস্যরা আল আমিনের লাশ সরিয়ে ফেলতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
আল আমিনের বাবা মো: নুরুল ইসলাম মনে করেন, তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। তার ছেলে ভুল বুঝতে পেরে বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছিল। সে জন্য অন্য জঙ্গিরা তাকে হত্যা করেছে। এ বিষয়ে তিনি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে যোহের মোহাম্মদ আবদুর রহমান ওরফে জহির (৩৩) নামে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার আরেক জঙ্গি সদস্য গত ৬ জুন ২০২২ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলাধীন বড়থলি ইউনিয়নের রেংত্লাই পাহাড় (কুকি মৌনে) স্থাপিত কেএনএফের ক্যাম্পে পাহাড়ের প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপের হামলায় নিহত হয়। তবে তাঁর কবরের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
গত ১১ জানুয়ারি ২০২৩ র্যাব কর্তৃক অপর ৪ জঙ্গী সদস্যসহ নিজামউদ্দিন ওরফে হিরণ নামে জঙ্গী সদস্য ধৃত হওয়ার পর জহিরের মৃত্যুর তথ্য দেন গ্রেফতারকৃত হিরণ।
বছর দেড়েক আগে ইসলামী জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নোয়াখালী থেকে বাড়ি ছেড়েছিল দুই বন্ধু নিজামউদ্দিন ওরফে হিরণ ও যোহের মোহাম্মদ আবদুর রহমান ওরফে জহির। তাঁদের মধ্যে জহির গত বছরের জুনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে হিরণ জানায়, তারা বড়থলি ইউনিয়নের রেংত্লাই পাহাড়ে (কুকি মৌনে) কেএনএফের যে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিত, সেখান গত ৬ জুন ২০২২ পাহাড়ের অপর একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলা চালায়। কেএনএফের সঙ্গে ওই প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপের হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হন জহির।
জানা যায়, প্রতিপক্ষের ৬ জুনের উক্ত সশস্ত্র হামলায় উক্ত ইসলামী জঙ্গী সদস্যসহ কেএনএফের ১৭ জন সদস্য নিহত হয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গীরা এতই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে, চাল, আলু, লবন, কাপড়-চোপড়সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এলোপাতাড়ি ফেলে রেখে বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গী সদস্যরা রোয়াংছড়ি উপজেলার রণিন পাড়া সংলগ্ন সেনা ক্যাম্পের পাশে সিপ্পি পাহাড়ে (রামেত্তং পাহাড়ও বলে থাকে) পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য যে, জঙ্গি দলে জহিরের ছদ্মনাম ছিল ডা: আহমেদ। নিহত জহিরের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার বিজয়নগরে। সে দুই সন্তানের জনক। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে তুরস্ক যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে চলে যায় জহির। তিন মাস পর ইমোতে কল করে জানায়, সে তুরস্কে আছে। পরে কয়েক মাস ধরে সে নিয়মিত ফোন করতো। হঠাৎ যোগাযোগ করা বন্ধ হয়ে যায়। পরে কয়েক দিন আগে জহির বান্দরবানে মারা গেছে পরিবারের সদস্যদেরকে র্যাব থেকে জানানো হয়।
র্যাব থেকে মারা যাওয়ার তথ্য জানানোর পর কয়েক দিন আগে জহিরের পিতা রফিক উল্লাহ বান্দরবানে গিয়ে ছবি দেখে ছেলেকে শনাক্ত করেন। তবে এখনো ছেলের লাশ তিনি খুঁজে পাননি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আল আমিনসহ কুমিল্লার সাত তরুণ গত বছরের ২৩ আগস্ট একযোগে নিখোঁজ হয়। পরে তাঁদের কয়েকজন বাড়ি ফিরে আসে বা গ্রেপ্তার হয়।
গ্রেফতারের পর জঙ্গী সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, তারাসহ বিভিন্ন এলাকার অর্ধশতাধিক তরুণ নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়ার জিহাদি কর্মকান্ডের জড়িত হয়ে ঘর ছাড়ে।
তারা বান্দরবানে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের আস্তানায় টাকার বিনিময়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। ওই আস্তানায় অন্তত ৫৫ জন জঙ্গি রয়েছেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতে গত অক্টোবরে অভিযান শুরু করেছিল সেনাবাহিনী, র্যাব ও এসএসএফ-এর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।