হিল ভয়েস, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, বান্দরবান: বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম থেকে বম ও মারমা গ্রামবাসীদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী প্রশ্রয় প্রদানকারী বমপার্টি খ্যাত কেএনএফ গ্রামবাসীদের হুমকি দিয়ে আসছে এবং সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণের দোহাই দিয়ে এলাকায় গুলিবর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এর ফলে ভয়ে পাইন্দু ইউনিয়নের বাসতালাই, আর্থা পাড়া, হ্যাপি হিল প্রভৃতি পাড়া থেকে বম গ্রামবাসী এবং মুয়ালপি পাড়া থেকে মারমা গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারের মিজো, কুকি ও চিন জনগোষ্ঠীর সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বম গ্রামবাসীদেরকে মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করতে কেএনএফ এধরনের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তিভোগী গ্রামের অনেকে মত প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, এই ষড়যন্ত্রের আলোকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনীর সাথে যাতে গুলি বিনিময় হয়, তজ্জন্য বমপার্টি নানা উস্কানীমূলক তৎপরতা চালাতে থাকে। ফলে এক পর্যায়ে শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল ১০:০০ ঘটিকা পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়ার ভেতরে বমপাটি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দূর থেকে গুলি বিনিময় হয়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়েছে বলে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
এরপর ভয়ে পেয়ে পাইন্দু ইউনিয়নের বাসতালাই পাড়া থেকে ৪৫ পরিবার, আর্থা পাড়া থেকে ৭০ পরিবার, হ্যাপি হিল পাড়া থেকে ৩৫ পরিবারসহ আনুমানিক ১৫০ পরিবার বম জনগোষ্ঠী উচ্ছেদ হয়ে মুয়ালপি পাড়া, বেথেল পাড়া ও রুমা সদরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে গতকাল শনিবার (২৮ জানুয়ারি) বমপার্টির ভয়ে পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া থেকে কমপক্ষে ৪৫ পরিবারের ১৭০ জন মারমা গ্রামবাসী উচ্ছেদ হয়ে রুমা সদরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে উপজেলা সদরে অবস্থিত মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ভবনে প্রায় ৫০ জন মারমা গ্রামবাসীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রাংসা পাড়া, ইলি চান্দা পাড়া, ক্যকটাই পাড়া, ক্রোংক্ষ্যং পাড়াসহ রুমার প্রায় ১২টি পাড়ার লোকজন ৩দিন ধরে আতঙ্কে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, মুয়ালপি পাড়ার কার্বারীর জামাইকে কেএনএফ ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে আহত অবস্থায় জঙ্গল থেকে তাকে উদ্ধার করে গ্রামবাসীরা। ঘটনাটি পর ওই গ্রামে লোকজনদের মাঝে আতঙ্ক শুরু হয়।
গ্রাম ছাড়ার জন্য বমপার্টির হুমকির ফলে গতকাল শনিবার (২৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় গ্রামবাসীরা সবাই পালিয়ে আসে শহরের দিকে। অনেক পরিবার জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। কোনো কোনো পরিবার তাদের আত্মীয়দের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, রুমা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার থেকে দুরত্ব মুয়ালপি পাড়াটি দূর্গম এলাকায় অবস্থিত হওয়াই গ্রামের ভিতর দিয়ে কেএনএফ সদস্যরা প্রতিনিয়ত চলাচল করত। তাদের এই চলাচলের কারণে গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তাদের অত্যাচারে সবাই ভয়ে থাকেন।
বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গ্রামবাসীদেরকে ভয় দেখাচ্ছে যে, তারা অচিরেই সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করতে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হলে সাধারণ গ্রামবাসীরাও হতাহত হতে পারে। তাই গ্রামবাসীদেরকে আগে থেকে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে নির্দেশ দিচ্ছে কেএনএফ সদস্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তিভোগী গ্রামের অনেকে বলেছেন যে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে বম গ্রামবাসীদেরকে মিজোরামে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করাতেই বমপার্টি সদস্যরা এধরনের নির্দেশ দিচ্ছে। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করানো সম্ভব হলে কেএনএফের প্রতি মিজো-কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর সহানুভূতি ও সমর্থন জোরদার হবে এই উদ্দেশ্যেই মূলত বম গ্রামবাসীদেরকে মিজোরামে শরণার্থী করানোর ষড়যন্ত্র করছে কেএনএফ।
বম গ্রামবাসীদেরকে শরণার্থী করানো সম্ভব হলে একদিকে শরণার্থীদের মধ্যে কেএনএফ সদস্যরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও শরণার্থীদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারবে, অন্যদিকে ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য তাদের বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছে তাও অন্যদিকে প্রবাহিত করা যাবে। এমন উদ্দেশ্য নিয়েই বমপার্টি গ্রামবাসীদেরকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ হবে বলে ভয় দেখাচ্ছে এবং স্ব স্ব গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অনেকে।
উল্লেখ্য যে, গত অক্টোবর ২০২২ থেকে ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানকারী বমপার্টির বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু হলে ইসলামী জঙ্গী, বমপার্টি ও সেনাবাহিনীর হুমকি ও উৎপীড়নের ফলে রুমার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বম জনগোষ্ঠীর ২৯৫ জন নিরীহ শিশু, নারী ও পুরুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতের মিজোরামের লংত্লাই জেলার চংতে মহকুমার চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
এরপর আরো কয়েক দফায় আশ্রয় নেয়ার পর মিজোরামে আশ্রিত বম শরণার্থীর সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৯০ জন। তাদের মধ্যে পারভা-৩ এলাকায় ২১২ জন, ভাঠুয়ামপুয় এলাকায় ৩৪ জন, মাওতলাং এলাকায় ৪৬ জন, চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় ৪৪ জন এবং মংবুহ এলাকায় ৫২ জনকে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ জো রে-ইউনিফিকেশন অর্গানাইজেশন (জোরো) কর্তৃক ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে মিজোরামের লংতলাই জেলায় পাঁচটি কেন্দ্রে ৭০০ জনের অধিক বম শরণার্থী রয়েছে বলে জোরো দাবি করা হয়েছে।
আরো উল্লেখ্য যে, ভাগ করো শাসন করো নীতির ভিত্তিতে জুম্মদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার হীনউদ্দেশ্যে বমপার্টি নামে খ্যাত এই সশস্ত্র গ্রুপটি সেনাবাহিনীর মদদে ২০০৮ সালে প্রথমে কেএনডিও নামে, পরে ২০১৬ সালে কেএনএফ নাম পরিবর্তন করে আবির্ভূত হয়।
কিন্তু গঠিত হওয়ার পর এক পর্যায়ে ২০২১ সাল থেকে মাসিক ৩০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাদের ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠনকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করে।
জুম্মদের দিয়ে জুম্মদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠন করে দেয়া হলেও দুর্গম পাহাড়ে ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে কেএনএফ আজ উল্টো বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহলের অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।