হিল ভয়েস, ১২ জানুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৭ কর্তৃক বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার দূর্গম এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আরও ৫ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জানা গেছে। এর পূর্বে গত ৮ জানুয়ারি ২০২৩ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও ঢাকার কদমতলী এলাকা থেকে পুলিশ কর্তৃক এই সংগঠনের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের সূত্র অনুযায়ী, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র যে ৫৫ জন সদস্য পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের কাছে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ৩১ সদস্যকে আটক করা সম্ভব হয়েছে।
তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এই জঙ্গি সদস্যদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণদাতা সেনামদদপুষ্ট বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গুটিকয়েক সাধারণ সদস্যকে র্যাব ও সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করলেও তাদের মূল নেতা ও সশস্ত্র সদস্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। এমনকি এখনো নিয়মিত বান্দরবানের দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় কেএনএফের ক্যাম্পে দিনের বেলায় ইসলামী জঙ্গীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং রাতে জঙ্গিদের জিহাদি বয়ান চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
আজ (১২ জানুয়ারি) র্যাবের মিডিয়া উইং এর সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গতকাল (১১ জানুয়ারি) উক্ত ৫ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান।
গ্রেপ্তারকৃত ৫ জঙ্গি সদস্য হল- (১) নিজামুদ্দিন হিরন ওরফে ইউসুফ (৩০), পীং- আব্দুল কুদ্দুস, গ্রাম-মুকিল্লা, সোনাইমুড়ি থানা, নোয়াখালী জেলা; (২) সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা (২৭), পীং-আব্দুর রাজ্জাক, ঠিকানা-কুমিল্লা জেলা; (৩) মোঃ সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন (৩০), পীং-সিরাজুল ইসলাম, ঠিকানা-সিলেট জেলা; (৪) মোঃ বাইজিদ ইসলাম ওরফে মুয়াজ ওরফে বাইরু (২১), পীং-মৃত শফিকুল ইসালাম, ঠিকানা-কুমিল্লা জেলা ও (৫) ইমরান বিন রহমান শিথিল ওরফে বিল্লাল (১৭), পীং-মোঃ মজিবুর রহমান, ঠিকানা-কুমিল্লা।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা, মোঃ সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন ও ইমরান বিন রহমান শিথিল ওরফে বিল্লালকে থানচির দুর্গম এলাকা থেকে এবং মোঃ বাইজিদ ইসলাম ওরফে মুয়াজ ওরফে বাইরু ও নিজামুদ্দিন হিরন ওরফে ইউসুফকে রোয়াংছড়ির দুর্গম এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
র্যাবের মিডিয়া উইং এর সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন এর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘গ্রেপ্তারকৃত নিজামুদ্দীন হিরণ ২০১৯ সালে ওমান থেকে দেশে ফেরার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে গমন করেন।
গ্রেপ্তারকৃত সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনিসহ আরো ৭ জন সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য বান্দরবানে অবস্থিত কেএনএফ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গমন করেন।
গ্রেপ্তারকৃত সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য বান্দরবান গমন করেন।
গ্রেপ্তারকৃত বাইজিদ ইসলাম ওরফে বাইরু ২০২১ সালের নভেম্বরের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য মাহমুদের তত্ত্বাবধানে সে বান্দরবান গমন করে অদ্যাবধি সেখানে অবস্থান করে আসছিলেন।
গ্রেপ্তার ইমরান বিন রহমান শিথিল ওরফে বিল্লাল ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি বান্দরবান গমন করে। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত ইমরান বিন শিথিল পাহাড়ে আত্মগোপনকৃত জঙ্গিদের সাথে অবস্থান করছিল।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায় পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের তত্ত্বাবধানে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে বান্দরবানের গহীনে জঙ্গি আস্তানায় আসে। কেএনএফ তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে।
তারা আরও জানায়, কেএনএফের এর প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুংলিয়ান বম, কথিত লে. কর্নেল সলোমন, কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই ওরফে মাওয়াইয়া এবং কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল ওরফে চির চির ময়সহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের নির্দেশনায় কেএনএফ সদস্যরা পাহাড়ে অবস্থানরত জঙ্গিদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সহায়তা করছে এবং এখনো জঙ্গিদেরকে প্রশিক্ষণ, খাবারসহ বিভিন্ন রসদ ও সরঞ্ছাম সরবরাহ করে যাচ্ছে।
র্যাবের মিডিয়া উইং এর সহকারী পরিচালক খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর রাঙামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব এই জঙ্গি সংগঠনের ৭ জন ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদল কেএনএফের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন।
এদিকে বান্দরবানের দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় কেএনএফের ক্যাম্পে দিনের বেলায় ইসলামী জঙ্গীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং রাতে জঙ্গিদের জিহাদি বয়ান চলছে বলে গত ২২ ডিসেম্বর ২০২২ রাজধানীর মিন্টু রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিল ভয়েসের অনুসন্ধানে জানা যায় যে, রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের সিলৌপি পাড়া ও থিংদলতে পাড়ার মাঝখানে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি ট্রেনিং সেন্টার (কেটিসি) নামে কেএনএফের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গী সদস্যদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
ইতোপূর্বে হিল ভয়েসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও সেনাবাহিনীর বান্দরবান ব্রিগেড ও রুমা জোন কর্তৃক বমপার্টিকে আশ্রয়–প্রশ্রয় প্রদান, ইসলামী জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক বমপার্টিকে পৃষ্টপোষকতা ও মদদ, বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গীদের মধ্যে গোপন চুক্তি সম্পাদন, সেই অনুসারে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের আস্তানায় ইসলামী জঙ্গীদেরকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তার বিনিময়ে অস্ত্র ক্রয়, থাকা–খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ ইসলামী জঙ্গীরা বমপার্টিকে মাসোয়ারা অর্থ সহায়তা প্রদান ইত্যাদি তথ্যাবলী উঠে আসে।
হিল ভয়েসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক বমপার্টিকে মাসে ৩০ লক্ষ টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।