পার্বত্য চট্টগ্রামে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে: মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

হিল ভয়েস, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তবে হতাশ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। এ জন্য তিনি সবাইকে ধৈর্য ধরে সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে রাঙ্গামাটি সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট অডিটোয়ামে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আয়োজনে গণশুনানিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এসব মতামত ব্যক্ত করেন। দেশব্যাপী মানবাধিকারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে গণশুনানীর আয়োজন করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপ করে আমরা বুঝতে পারছি পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমরা চাই একটি সমৃদ্ধশীল সৌহাদ্যপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ে উঠুক। সব সম্প্রদায়ের মানুষ অসম্প্রদায়িক মতাদর্শে একই সঙ্গে বসবাস করুক। এ লক্ষ্যে সবার মতামতের সুপারিশমালা আমরা সরকারকে পাঠাবো।

রাঙ্গামাটি জেলার ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সংরক্ষিত সদস্য সেলিম রেজা, সদস্য কাওসার আহমেদ, সদস্য কংজরী চৌধুরী, কমিশনের সচিব নারায়ণচন্দ্র সরকার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ উপস্থিত ছিলেন।

গণশুনানীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের মানবধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসহ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের যথাযথ পুনর্বাসন করা হয়নি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো বলেন, ‘চুক্তির পর ২৫টির বেশি সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে জুম্ম জনগণের উপর এই হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় শত শত জুম্ম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পর্যটনের নামে ভূমিহারা হচ্ছে জুম্মরা। ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পালিয়ে যাওয়া বম উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’

উক্ত গণশুনানীতে অংশগ্রহণকারী অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে, গণশুনানীর নামে এটা পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমাবেশ হয়েছে। জুম্মদের উপর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগ ও ভূমি বেদখলে জড়িত ব্যক্তি, পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও সুবিধাবাদী তাবেদার ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদেরকেই মূলত এই গণশুনানীতে ডাকা হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা গণশুনানী সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন যে, গণশুনানীতে ১৯৭৯ হতে ১৯৯৩ সালের মধ্যে এক ডজনের বেশি গণহত্যায় চল্লিশ হাজারের অধিক আদিবাসী জুম্ম গণহত্যাকারী বেআইনী অনুপ্রবেশকারী সেটেলার, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরবর্তীতে জুম্মদের উপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, জমি বেদখলসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিদেরই দাপট ছিল বেশি। প্রশাসন থেকে খবর পেয়ে বিভিন্ন উপজেলা থেকে বহু সেটেলার সুপরিকল্পিতভাবে গণশুনানীতে উপস্থিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার আদিবাসী জুম্ম জনগণ ছিল সেখানে সম্পূর্ণ কোনঠাসা। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা এবং প্রশাসনের ভয়ে আদিবাসী জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিগণ ঠিক মতো কথা বলতে পারেননি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণশুনানীতে অংশগ্রহণকারী একজন জুম্ম অধিকার কর্মী বলেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের’ চেয়ারম্যান কাজী মজিবুর রহমান তো বটেই, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরাও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের অধিকার সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে আশ্চর্যজনকভাবে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তারা পার্বত্য চুক্তিতে স্বীকৃত আদিবাসী জুম্মদের বিশেষ অধিকারকে সংবিধান বিরোধী বলে মানবাধিকার কমিশনের সদস্যদের সামনে একতরফা ও মনগড়া বক্তব্য প্রদানে করেছেন। অথচ সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মতো প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও অধিকার প্রদানের বিধান রয়েছে, সে সম্পর্কে মানবাধিকার কমিশনের সদস্যরাও ছিলেন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কেবল তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনকে চাঁদাবাজ ও অবৈধ অস্ত্রধারী হিসেবে উল্লেখ করে গণশুনানীকে একপ্রকার তামাশায় করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

গণশুনানীতে অংশগ্রহণকারী আরেক জুম্ম নারী অধিকার কর্মী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হচ্ছে অন্যতম একটি হাতিয়ার। অথচ সেই চুক্তি বাস্তবায়নে কেউই টু শব্দটিও উল্লেখ করেননি। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মধ্যে সামরিকায়নের মাধ্যমে দমন-পীড়ন চালিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো সেনাবাহিনী কর্তৃক অস্ত্র গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার, ক্রস ফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, মিথ্যা মামলা জড়িত করে জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে নিয়ে মারধর ও দিনের পর দিন আটকে রাখা, ঘরবাড়ি তল্লাসী ও জিনিসপত্র তছনছ, জুম্মদের ভূমি বেদখল ও সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগ্নিসংযোগে সেটেলারদের মদদ প্রদান, জুম্মদেরকে স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, জুম্ম নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আজ পার্বত্যবাসীর নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি চঞ্চনা চাকমা বলেন, মানবাধিকার হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত সহজাত অধিকার। মানবাধিকারের সুরক্ষা করা, প্রসার ঘটানো ও সম্মান প্রদর্শনের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। অথচ সেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত জুম্ম জনগণের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। কিন্তু সেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ উচ্চবাহ্য না করে মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আদায়ের জন্য যারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে করা হয়েছে জাতীয় মানাবধিকার কমিশনের আহুত সেই গণশুনানীতে। কি সেলুকাস!

More From Author