হিল ভয়েস, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন: সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত ইসলামী জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা একটি ভিডিওতে পাওয়া গেল বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ে বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) কর্তৃক জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামক ইসলামী জঙ্গীদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ভিডিও প্রামাণ্য চিত্র।
সমতলে অবস্থানকারী ইসলামী জঙ্গী সদস্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার লক্ষ্যেই এই ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
বড় ধরনের হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গী সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের সময় ভিডিওটি প্রকাশ করার জন্য ইসলামী জঙ্গীদের পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়।
গত মঙ্গলবার ২৪ জানুয়ারি ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ভিডিও চিত্রটি প্রকাশ করেছে র্যাব।
ভিডিওতে সামরিক পোশাকের আদলে তৈরি পোশাক পরে একে-২২ রাইফেল ও শটগান নিয়ে প্রশিক্ষণের দৃশ্য ধারণ করা হয়। তাতে ২২-২৩ জন ইসলামী জঙ্গীকে দেখা গেছে।
ভিডিওর শুরুতেই জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, কথিত সামরিক কমান্ডার শিব্বির আহমেদ ওরফে হামিদ কারসে, মো. দিদার ওরফে চাম্পাই, দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুনকে দেখা যায়।
ভিডিওতে সালেহ ও আল-আমিন নামের আরও দুজনকে দেখা গেছে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সালেহ কয়েক দিন আগে বান্দরবানে শারক্বীয়ার দুই সদস্যের কবরের সন্ধান দিয়েছিলেন।
এছাড়া গত সোমবার ২৩ জানুয়ারি উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গ্যা ক্যাম্পের পাশের জঙ্গল থেকে গ্রেফতারকৃত আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে ভিডিওতে দেখা গেছে।
ভিডিওতে বমপার্টি নামে খ্যাত বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের এক প্রশিক্ষককেও চিহ্নিত করা গেছে বলে র্যাব দাবি করেছে।
ভিডিওতে বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখানো হয়েছে। সেগুলো হলো রুমার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নে স্থাপিত জর্দান ক্যাম্প, রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের কুকি মৌনে স্থাপিত রেংতলাঙ ক্যাম্প, রোয়াংছড়ির আলিক্ষং ইউনিয়নের সিপ্পি পাহাড়ে স্থাপিত রামজুদান ক্যাম্প।
ভিডিওতে মূলত কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়, আত্মরক্ষার কৌশল কী, কিংবা এ্যাম্বুশের মধ্যে পড়লে তাদের অবস্থান কেমন হবে, সে কৌশলগুলো ধারণ করা হয়েছে।
শত্রুর ক্যাম্পে হানা দেওয়ার সময় কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সদস্যরা অবস্থান করবেন, সেই অভিযানের মহড়া রাখা হয়েছে ভিডিওতে।
এই ভিডিওর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করা। জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক শাখায় যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাদের করণীয় কী হবে, সেই উদ্দেশ্যেও ভিডিওটি করা হয়েছে।
সমতলে অবস্থানকারী বিভিন্ন জঙ্গী সদস্যদেরকে ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করাও ছিল ভিডিও’র অন্যতম একটি মূল লক্ষ্য।
বড় কোনো হামলার মধ্য দিয়ে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের সময় ভিডিওটি প্রকাশ করতে চেয়েছিল জঙ্গিরা। এ লক্ষ্যে ওয়েবসাইটও তৈরির প্রস্তুতি চলছিল।
উল্লেখ্য যে, শামীম মাহফুজ নামে একজন ইসলামী জঙ্গী নেতা বান্দরবান থানচি-আলিকদম-নাইক্ষ্যংছড়ি-লামা এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু অংশ নিয়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে কার্যক্রম শুরু করেন।
এরপর ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন- আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের সাবেক কয়েকজনের উদ্যোগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন সংগঠনের কার্যক্রম করা হয়।
নতুন এই জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে বমপার্টি খ্যাত পাহাড়ের নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফ সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। টাকার বিনিময়ে কেএনএফ বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি এবং রাঙ্গামাটির বিলাইছড়িতে তাদের ক্যাম্পে জামাতুল আনসারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। সেই চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
২০২১ সালের শেষ দিকে কেএনএফের ক্যাম্পে এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সেখানে অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরি, ঝটিকা ও চোরাগোপ্তা হামলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। জামাতুল আনসার এখন পর্যন্ত বমপার্টির ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তিন দফায় জঙ্গী সদস্যদের তিনটি ব্যাচ পাঠিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ব্যাচে ১২ জন, দ্বিতীয় ব্যাচে ৩১ জন, তৃতীয় ব্যাচে ১২ জনসহ মোট ৫৫ জনকে পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।
আরো উল্লেখ্য যে, ‘ভাগ করো শাসন করো’ উপনেবিশক নীতির ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর মদদে ২০০৮ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার নাথান বমকে সভাপতি ও ভাঙচুনলিয়ান বমকে সাধারণ সম্পাদক করে বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও তাবেদার ব্যক্তি কর্তৃক কুকি-চিন ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ঐ সংগঠনটির নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে এর সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করা হয়।
আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর মদদে বমপার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক প্রচারনা শুরু করে। সেনাবাহিনীর মদদ গঠিত হলেও একপর্যায়ে দুর্গম পাহাড়ে ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে কেএনএফ আজ বাংলাদেশের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।