হিল ভয়েস, ৯ জানুয়ারি ২০২৩, রাঙ্গামাটি: সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি জেলাধীন জুরাছড়ি উপজেলায় প্রায় ১৬ দিনব্যাপী এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে সেনা সদস্যরা স্থানীয় জুম্মদের ব্যাপক হয়রানি, বাড়িতে তল্লাশিসহ, বিনামূল্যে ইচ্ছেমত জুম্মদের গৃহপালিত গরু, ছাগল, মোরগ-মুরগী ও চাল ভোজন করে। ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে শীতের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ আটক রাখে এবং স্থানীয় জুম্ম গাছ বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীর ৬৬১৬টি সেগুন গাছের গুড়ি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জব্দ করে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা বলে জানা গেছে। সেনা নির্যাতনের ভয়ে গ্রামবাসী অনেকেই তীব্র শীতের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় বলে খবর পাওয়া যায়। গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ হিল ভয়েস-এ “জুরাছড়িতে সেনা অভিযান: জুম্মদের হয়রানি, বাড়ি তল্লাসি, বিনামূল্যে গবাদিপশু, চাল ভক্ষণ” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
সেনাবাহিনী তাদের এই নিপীড়ন ও হয়রানিমূলক কার্যক্রম ও সংবাদ ধামাচাপা দিতে জুরাছড়িতে জেএসএসের আস্তানায় সেনাবাহিনীর অভিযান ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে বলে প্রেস বিবৃতি দিয়ে জেএসএসকে নিয়ে মিথ্যা প্রচার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৯ জানুয়ারি ২০২৩ দৈনিক গিরিদর্পণ ও ৮ জানয়ারি ২০২৩ পাহাড় বার্তায় যথাক্রমে ‘জুরাছড়িতে জেএসএস সন্ত্রাসীর আবাসন ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযান, বিভিন্ন সরঞ্জমাদি উদ্ধার’ এবং ‘রাঙ্গামাটিতে জেএসএসের আস্তানায় সেনা অভিযান’ শিরোনামে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
উক্ত সংবাদে সেনাবাহিনীর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে- রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ৭০-১শ সন্ত্রাসীর আবাসিক ক্যাম্পে অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করা না গেলেও উদ্ধার করা হয়েছে গুলি, কার্তুজ, অন্যান্য সরঞ্জাম। জানুয়ারি ৪ হতে ৬ তারিখ পর্যন্ত জুরাছড়ি বেলতলা এলাকার ন্যাড়া পাহাড়ে এ অভিযান চালানো হয়েছে। এছাড়াও এক মেট্রিক টন খাদ্যশষ্য ও বিপুল পরিমাণের গবাদিপশু পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্থানীয় গ্রামবাসী ও জেএসএস কর্মীবৃন্দ সেনাবাহিনীর এই বিবৃতিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ ডিসেম্বর ২০২২ হতে জুরাছড়ি উপজেলাধীন বারোদগোলা, বেলতলা, চালকা পাড়া, আমতলা, শালবাগান, থাচি পাড়া, ক্যারানি পাড়া, পানছড়িমুখ, জামুরাছড়ি, ভুয়াতলী ছড়া, মোনঅ আদাম, রাজাতল, বাদলহাট ছড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। গত ৬ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত উক্ত এলাকায় সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক মুরুব্বি বলেন, ‘এই অপারেশনে সেনাবাহিনী জেএসএস সদস্য কিংবা সাধারণ মানুষকে কাউকে গ্রেফতার করতে না পারাতে তাদের উপরওয়ালা সেনা নেতৃত্বকে সান্ত্বনা কিংবা বুঝ দেওয়ার মতন অপারেশনে তেমন কিছুই অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে ‘রাঙ্গামাটিতে জেএসএসের আস্তানায় সেনা অভিযান’ শিরোনামে জেএসএসকে দোষারোপ করে মিথ্যাচার করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক জেএসএস নেতা বলেন, জেএসএস আবাসিক ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীর গুলি, কার্তুজ, চাঁদাবাজির রসিদ, বইপত্র, জেএসএস-এর নথিপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করো এবং বেলতলা নেড়া পাহাড়ে জেএসএস-এর সশস্ত্র ৭০ হতে ১০০ জন সদস্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে- এসকল সংবাদ সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, সেখানে জেএসএস এর কোনো ক্যাম্প থাকা এবং কোনো কাগজপত্র উদ্ধারের প্রশ্নই ওঠে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অভিযানকালে গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ জুরাছড়ি সদর উপজেলার যক্ষাবাজার থেকে ফেরার সময় মৈদুং ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আমতলা গ্রাম নিবাসী শম্ভু চাকমা (৬৫) নামে এক বয়স্ক ব্যক্তিকে আটক করে সেনাবাহিনী সারারাত তাদের হেফাজতে রেখে পরদিন (২৮ ডিসেম্বর) সকাল ১১:০০ টায় ছেড়ে দেয়। এরপর গতকাল ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সেনা সদস্যরা অন্তত তিনটি বাড়িতে তল্লাসি চালায় বলে জানা যায়। অপরদিকে একই দিন জোন কম্যান্ডার জুলকিফলী আরমান বিখ্যাত’র উপস্থিতিতেই সেনা সদস্যরা মৈদুং ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বেলতলা এলাকায় বিনামূল্যে ও বিনা অনুমতিতে জনৈক গ্রামবাসীর ৭০/৮০ হাজার টাকা মূল্যের একটি গরু জবাই করে খেয়ে দিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।
অভিযানের সময় সেনা সদস্যদের কর্তৃক মৈদুং ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলতলা ও আমতলা এলাকায় জুম্মদের বাড়িতে ছাগল, মুরগী, যা সামনে পায় তা ইচ্ছেমত বিনা পয়সায় খেয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া মৈদুং ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের বেলতলা গ্রামে (১) সত্যবান চাকমা (৫০), (২) ইন্দ্রবান চাকমা (৫৫), (৩) বিচ্ছে নাগা চাকমা ও (৪) পন্দক চাকমা নামে চার জনের বাড়িতে অবস্থান করে তাদের বাড়ির ধান মেশিনে মাড়াই করে ইচ্ছেমত খেয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।