নিপন ত্রিপুরা
গত ২০ জুানুয়ারি ২০২৩ রাঙ্গামাটির সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের গণশুনানিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে নিয়ে সেটেলার পান্ডা বহিরাগত কাজী মুজিবুর রহমান এবং কাপ্তাই উপজেলার মগ পার্টি সন্ত্রাসীদের গড ফাদার অংশু ছাইন চৌধুরীর প্রদত্ত বক্তব্য শাসকগোষ্ঠীর ধান্ধাবাজ চরিত্রেরই পরোক্ষ বহি:প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাদের বক্তব্য আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক, একপাক্ষিক এবং উস্কানিমূলক। এই দুইজন পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের আউটপুট বাই-প্রোডাক্ট ছাড়া কিছু নয়। শাসকমহলের ধান্ধাবাজ গোষ্ঠীর কথায় কথায় তাদের উঠাবসা। চলমান রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের ভূখন্ডে সামরিক আগ্রাসনে সাবেক রুশ সেনাদের নিয়ে গঠিত মার্সেনারি গ্রুপ বা ভাড়াটে বাহিনী কুখ্যাত “দ্যা ওয়াগনার গ্রুপ” নিরস্ত্র বা সশস্ত্র ব্যক্তি সরবরাহকারী ইয়োজিনির মতন কাজী মুজিবুর রহমান ও অংশু ছাইনের কার্যক্রম। তারা মূলত প্রশাসন ও শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ মহলের দুই ভিন্ন ভাড়াটে এজেন্ট বা তল্পীবাহক।
গত ২০ তারিখ অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে সেটেলার চ্যালা কাজী মুজিবুর রহমান বলেছেন, সন্তু লারমা সরকারের সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু কোনোদিন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে, শহীদ মিনারে ফুল দেন না ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। চুক্তির বিরুদ্ধেও নানা মনগড়া যুক্তি তুলেন এবং সুকৌশলে চুক্তি লংঘনের পক্ষে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেন। তবে কাজী মুজিবুর রহমানের এ ধরনের প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। তিনি এর আগে বহু জায়গায় এধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও এই ধরনের বাই-প্রোডাক্ট শ্রেণির এক সাংবাদিক একই প্রশ্ন করেছিলেন জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা সন্তু লারমাকে। পারলে সংবাদ সম্মেলন ভন্ডুলও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে সাধ্য তাদের ছিল না বলে সম্ভব হয়নি।
শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা সম্পর্কে ভূমি বেদখলকারী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটেলারদের এ অংশটি রাষ্ট্রীয় মদদ পেয়ে নানা সময়ে মাথাচারা দিয়ে ওঠে। সন্তু লারমা বিদেশে গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো এবং দেশের মধ্যেও তাঁর নামে কুৎসা রটানোই হল তাদের স্বাভাবিক চরিত্রের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রী লারমার বিরুদ্ধে যেন নানামুখী চক্রান্তের শেষ নেই। সেটেলার কাজী মুজিবুর তাঁকে নিন্দা করা বিনে নন্দিত করবেন না এটা অবশ্য একেবারে স্বাভাবিক। কেননা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে অবৈধভাবে পাহাড়িদের জায়গা দখল করে দীর্ঘ বছর থাকা কাজী মুজিবুর জায়গার প্রকৃত মালিকদের নিকট জায়গা ছেড়ে দিয়ে সমতল অঞ্চলে চলে যেতে হবে। এতে তার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধান্ধাবাজির সুযোগ বন্ধ হবে। এত বছর ধরে তার জমানো অর্থ ও অবৈধভাবে বেদখল করা ভূমি, শাসকগোষ্ঠীর দয়া তার উপর থাকবে না।
৮০-এর উর্ধ্ব বয়সী শ্রী লারমা উড়ে এসে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়াম্যানের পদ দখল করেননি। ষাট দশক থেকে এখনো অটল সংগ্রামী জীবনে প্রাণের দুইভাইকে যুদ্ধের ময়দানে হারালেও জুম্ম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছেন। স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আসীন হয়েছেন। যা বিধি এবং আইন সম্মত। চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য জেলা পরিষদের স্থানীয় ভোটার তালিকা প্রণয়নপূর্বক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ভোটে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান থাকলেও সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের অনীহার কারণে সেসব কিছুই হচ্ছে না। তাঁর ভোটার আইডি কার্ড, জন্ম নিবন্ধন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অহেতুক এবং অবান্তর বৈ কিছু নয়। শ্রদ্ধেয় লারমা একজন সাচ্চা বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক এবং দিঘীনালা স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি জুম্ম ছাত্র-যুবদের সংগঠিত করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামীলীগের জুম্ম-বিদ্বেষী ও স্বার্থান্বেষী নেতৃত্বের ষড়যন্ত্রের কারণে জুম্ম ছাত্র-যুবদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়।
তিনি কেবল জুম্ম জনগণের অধিকারের কথা বলেন না, তিনি এদেশের খেটে-খাওয়া মেহনতি ও স্বল্প আয়ের আদিবাসী-সংখ্যালঘু-বাঙালি জনগোষ্ঠীসহ বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের অধিকারের জন্য সর্বদা সোচ্চার। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছাত্র-যুব সমাজকে আদর্শিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার বিভিন্ন পরামর্শ এবং উদ্দীপনা যুগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের জন্য দিঘীনালা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা হয়েছিল। তাঁর আইডি কার্ড আছে কি নাই, তিনি দেশের মানুষ না বিদেশের মানুষ সেটা তো সরকারি নথিপত্রে রেকর্ড আছে। নতুন করে বলার কোন প্রশ্নই আসে না।
প্রশ্ন উত্থাপনকারী সেটেলার চ্যালা কাজী মুজিবুর রহমানের বাড়ি বরিশাল বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক তিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাও না। বরিশাল থেকে বান্দরবানে এসে এক সময় রাজমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করতেন। এরপর তিনি শ্রমিক নেতা হন। পরে বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অন্তবর্তীকালীন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য বনে যান যা কোনোভাবে চুক্তি মোতাবেক বিধি সম্মত নয়। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক তিনি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্যও হতে পারেন না। কেননা একমাত্র যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে রীতি, আইন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈধ জমির মালিক, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দা, তিনি ভোটার এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য প্রার্থী হতে পারবেন। কিন্তু সেটলারকে পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে প্রোডাক্ট করার কৃতিত্ব হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেও প্রতারনা করা রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগেরই।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকাকালীন দীর্ঘ বছর উগ্র সাম্প্রদায়িক সেটেলার সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন করতেন। তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, দুর্নীতি, ঘুষ, ভূমি বেদখল, অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ পাহাড়সম। ২০১৫ সালের ৬ জুন বান্দরবানের রাজার মাঠে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে কাজী মুজিবুর রহমান পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ, সমঅধিকার ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা চালায়। এ সময় অন্তত ২৫ জন আহত হয়। আর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৭ জুলাই ২০১৫ বান্দরবান আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের ২১ নেতাকর্মী (জামায়াত শিবিরের মদদপুষ্ট) এবং ২৪ জুলাই ২০১৫ বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মুজিবুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় (তথ্যসূত্র: রাইজিংবিডি, ১৯ আগস্ট ২০১৫)। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত ‘মাহবুবুর রহমান স্মৃতি সংসদ’ নামক ভবনটি এখন বন্ধুয়ালয় নামে একটি সংগঠনের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দখল করে নিয়েছেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাঙ্গু নদীর পাড় অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে নদীর তীর ঘেঁষে রিভার ভিউ হোটেল গড়ে তুলেছেন বলে জানা যায়।
অপরদিকে অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য অংশু ছাইন চৌধুরী ২০১৮ সালে নিরাপত্তাবাহিনী এবং আওয়ামীলীগ কর্তৃক সৃষ্ট মগ পার্টির কাপ্তাই এলাকার গডফাদার। তিনি গণশুনানিতে বলেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হত্যার হুমকির ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারেন না। পাহাড়ের সমগ্র জুম্ম জনগণ চায় পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড় থেকে ছয়টি ক্যান্টনম্যান্ট বাদে চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পসহ সকল অবৈধ অস্ত্রধারীর বিলোপ ঘটুক। কিন্তু অংশু ছাইন চৌধুরীর দল আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন চায় না বলে মদদ দিয়ে পাহাড়ে আজ বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টি করে চলেছে। অংশু ছাইন সরকারের কাছে বিচার চাওয়ার আগে, জানতে চাওয়া উচিত, সরকার চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করছে না কেন? চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আর কত বছর লাগবে? কেননা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তবে তিনি প্রশ্ন করার সাহস পারছে না। মগ পার্টি নামক একদল সশস্ত্র দলের পালনকর্তা বলে তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন করতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে ২০২১ সালের ৩নং চিৎমরম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভাইপো ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ওয়েশ্লিমং চৌধুরীকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে ১৬ অক্টোবর গভীর রাতে সুকৌশলে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের প্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে নিজের মদদপুষ্ট মগ পার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উপর দায় চাপিয়ে দেয়। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার মারফতে জানা যায়, উক্ত ইউনিয়নে অংশু ছাইন চৌধুরীর ভাইপো ওয়েশ্লিমং চৌধুরী নৌকার প্রার্থী হতে চেয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে নেথোয়াই মারমার ছেলে বলেন, সবুজ গেঞ্জি পরিহিত ১০-১৫ জনের একদল সশস্ত্র দল মারমা ভাষায় দরজা খুলতে বলে। পরে তারা দরজা ভেঙে গুলি করে হত্যা করে উল্লাস করতে করতে পালিয়ে যায়। এটা সত্য যে, হত্যাকারীরা মগ পার্টির সশস্ত্র সদস্য।
নানা ঘটনার পরিক্রমায় উক্ত ইউনিয়নে আওয়ামীলীগ অংশু ছাইন চৌধুরীর ভাইপো ওয়েশ্লিমং চৌধুরীকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। গত বছর নিজ ইউনিয়নে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে স্থানীয় হেডম্যানদের থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে মগ পার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধে বিচরণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সেনাক্যাম্প স্থাপনের পাঁয়তারা করেছিল। এলাকাবাসীর তীব্র প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয়নি। তবুও অংশু ছাইন চৌধুরীর সেনাক্যাম্প স্থাপনের চেষ্টা চলমান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত ও বিতর্কিত করার জন্য শাসকগোষ্ঠী কাজী মুজিবুর রহমান ও অংশু ছাইনের মত পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু বাই-প্রোডাক্ট গোষ্ঠী/দল সৃষ্টি করে চলেছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর যত দল সৃষ্টি হয়েছে সবই শাসকগোষ্ঠীর বাই-প্রোডাক্ট। এ সকল সংগঠন অধিকারের নামে লোক ভুলানো কথা বলে কার্যত শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের এজেন্ট হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নসহ সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। কেউই জুম্ম জনগণের মুক্তি দিশা দিতে পারবে না। এরা জাতির বিষফোঁড়া বৈ কিছু নয়। মিছে মিছে গল্প বলে সমাজে পচন ধরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে যাবে। তাদের রুখে দিতে হবে। দমন করতে হবে। প্রতিহত করতে হবে। তবেই জুম্ম জনগণের প্রকৃত মুক্তির পথ উন্মুক্ত হবে।