হিল ভয়েস, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, বান্দরবান: ম্রো, লুসাই, খুমী ও খিয়াং ও পাংখো জাতির জনগণ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর সশস্ত্র তৎপরতা ও কার্যক্রম এবং “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” নামক ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় প্রদানের নীতিকে সমর্থন করে না। তাই কেএনএফ কার্যকলাপের সাথে ৫ জাতির নাম জড়িত করে কেএনএফের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে ৫ জাতির প্রতিনিধিবৃন্দ।
আজ বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল ১১:০০ ঘটিকায় ‘বান্দরবানের শান্তিপ্রিয় জনগণ’-এর ব্যানারে ম্রো, লুসাই, খুমী ও খিয়াং ও পাংখো জাতির প্রতিনিধিবৃন্দ বান্দরবান শহরের অরুন সারকী টাউন হলে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এই প্রতিবাদ তুলে ধরেন।
উক্ত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ৫ জাতি জনগণের পক্ষে স্বাক্ষর করে প্রফেসর থানজামা লুসাই, সিং ইয়াং খুমী, খামলাই ম্রো, সিং ইয়াং ম্রো, ম্রা ছা খেয়াং, বাছা খেয়াং, লেলুং খুমী ও জলরম থং প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
উক্ত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয় যে, সাম্প্রতিক সময়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন আবির্ভূত হয়েছে। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে, তিন পার্বত্য জেলার বম, পাংখো, লুসাই, ম্রো, খুমী ও খিয়াং- এই ছয় জাতির সমন্বয়ে এই সশস্ত্র সংগঠন গঠিত হয়েছে এবং এই ছয় জাতির লোকজনদের সাথে নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংগঠন আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়েছে।
৫ জাতির প্রতিনিধিরা সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরো বলেন যে, “এই ছয় জাতির মধ্যে আমরা ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাস করে আসছি। বস্তুত এই সংগঠনের কার্যকলাপের সাথে আমাদের এই পাঁচ জাতির নাম জড়িত করে প্রচার করা হলেও আমরা ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতি এই সশস্ত্র গ্রুপ গঠনের ক্ষেত্রে জড়িত নই এবং এই সংগঠনের কার্যকলাপের সাথেও সম্পৃক্ত নই।
কেএনএফ আমাদের ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতির নাম ব্যবহার করে কখনো ‘কুকি-চিন রাজ্য’, কখনো বা ‘খ্রীষ্টান রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধিতা করে জনমতকে বিভ্রান্ত করা ও বান্দরবান জেলায় জাতিগত বিভাজন তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
৫ জাতির প্রতিনিধিরা আরো বলেন, কেএনএফ শুধু সশস্ত্র গ্রুপের কার্যকলাপের সাথে একতরফাভাবে ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতির নাম ব্যবহার করছে না, তাদের আস্তানায় ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতিসমূহকে সন্ত্রাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিপন্ন করে তুলেছে। এতে করে কেএনএফ ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতির নিরাপত্তা, জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে ৫ জাতির প্রতিনিধিরা অভিমত তুলে ধরেন।
পরিশেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিনিধিরা বলেন, “এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ম্রো, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও পাংখো জাতির প্রতিনিধি হিসেবে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, কেএনএফ গঠন, সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, জাতিগত বিভাজন ও ইসলামী জঙ্গীদেরকে আশ্রয় প্রদান, পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা ইত্যাদি হঠকারী তৎপরতার সাথে আমরা এই চার জাতির জনগণ কোনক্রমে জড়িত নই।”
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ১৩ হাজার বম জনগোষ্ঠীর সকলেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। যাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, যারা বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করতে চাইছে, মূলত তারাই কেএনএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে তারা জানান।
উল্লেখ্য যে, ‘ভাগ করো শাসন করো’ উপনেবিশক নীতির ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীদের মদদে ২০০৮ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার নাথান বমকে সভাপতি ও ভাঙচুনলিয়ান বমকে সাধারণ সম্পাদক করে বম জনগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও তাবেদার ব্যক্তি কর্তৃক কুকি-চিন ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে বমপার্টি গঠন করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ঐ সংগঠনটির নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) নামে এর সশস্ত্র গ্রুপ গঠন করা হয়। আবির্ভাব হওয়ার সাথে সাথে এই সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক প্রচারনা শুরু করে।
হিল ভয়েসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর বান্দরবান ব্রিগেড ও রুমা জোন কর্তৃক বমপার্টিকে আশ্রয়–প্রশ্রয় প্রদান, ইসলামী জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক বমপার্টিকে পৃষ্টপোষকতা ও মদদ, বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গীদের মধ্যে গোপন চুক্তি সম্পাদন, সেই অনুসারে বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের আস্তানায় ইসলামী জঙ্গীদেরকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তার বিনিময়ে অস্ত্র ক্রয়, থাকা–খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি বাবদ ইসলামী জঙ্গীরা বমপার্টিকে মাসোয়ারা অর্থ সহায়তা প্রদান ইত্যাদি তথ্যাবলী উঠে আসে।
হিল ভয়েসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন কর্তৃক বমপার্টিকে মাসে ৩০ লক্ষ টাকা অর্থ সহায়তাপ্রদান করা হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
৬ অক্টোবর ২০২২ র্যাবের সংবাদ ব্রিফিং-এর মাধ্যমে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’ নামক জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় প্রদানের তথ্য প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী, র্যাব ও এসএসএফ কর্তৃক ইসলামী জঙ্গী ও কেএনএফের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়।
এতে করে বম জনগোষ্ঠীর সাধারণ জনগণ চরম ভোগান্তিতে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতার ফলে প্রায় তিন শতাধিক বম গ্রামবাসী ভারতের মিজোরামের লংত্লাই জেলার চামদুর প্রজেক্ট এলাকায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে।