হিল ভয়েস, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: ইসলামী জঙ্গী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’র সদস্যদেরকে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ক্যাম্পে দৈনিক রুটিন করে সামরিক কায়দায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সারা দিন বিভিন্ন শারীরিক কসরত ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ চলছে। আর রাতে সংগঠনের বিভিন্ন সিনিয়র নেতারা ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে বয়ান দিতেন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছেড়ে আসা এসব কিশোর ও তরুণদেরকে। এসব বয়ানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীরা অল্প কিছু দিনের মধ্যে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার প্রধান শামীম মাহফুজকে চিনতে পাবেন।
গত বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) রাজধানীর মিন্টু রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, গত বুধবার (২১ ডিসেম্বর) সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম তুহিন (২১) ও ঢাকা থেকে নাঈম হোসেনকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। এর মধ্যে তুহিনের বাড়ি সিলেটে ও নাঈমের বাড়ি চাঁদপুরে।
হিল ভয়েসের অনুসন্ধানে জানা যায় যে, রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের সিলৌপি পাড়া ও থিংদলতে পাড়ার মাঝখানে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুকি ট্রেনিং সেন্টার (কেটিসি) নামে কেএনএফ একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেছে। সেখানে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার জঙ্গী সদস্যদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে কেএনএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, গত অক্টোবর থেকে যৌথ বাহিনীর কম্বিং অপারেশনের পর কেএনএফ ও ইসলামী জঙ্গী সদস্যরা এখন দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দুর্গম পাহাড়ে অবস্থান করছে। তার মধ্যে একটি গ্রুপ এই কেটিসি ক্যাম্পে থাকে এবং আরেকটি গ্রুপ রোয়াংছড়ি উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের মুননুয়াম পাড়ার সন্নিকটে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান করে থাকে বলে হিল ভয়েসের অনুসন্ধানে জানা গেছে। তবে অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, রহস্যজনকভাবে সেনাবাহিনী বাহিনী এখনো এই দু’টি ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করেনি। এক্ষেত্রে বান্দরবানে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের বিশেষ ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।
আরো উল্লেখ্য যে, বান্দরবানে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মদদে ও পৃষ্টপোষকতায় ২০০৮ সালে বমপার্টি খ্যাত কেএনডিও/কেএনএফ গঠিত হয়েছে। কেএনএফের সশস্ত্র কার্যক্রম এবং অর্থের বিনিময়ে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া নামক আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়টি জেনেও না জানার ভান করে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তারা প্রকারান্তরে মদদ দিয়ে এসেছিল।
২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যৌথ বাহিনী পাহাড়ে অভিযান শুরু করলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার দুই সদস্য। পরে দলছুট হয়ে প্রায় এক মাস হেঁটে পাহাড় থেকে সমতলে আসে তারা। এই দুজন প্রায় এক বছর কেএনএফের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেয়। সমতলে আসার পর গোয়েন্দা নজরদারিতে সিটিটিসি তাদের গ্রেফতার করে।
আসাদুজ্জামান বলেন, কেএনএফের সাহায্যে নতুন ইসলামী জঙ্গি সংগঠন পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অভিযানে নতুন ইসলামী জঙ্গি সংগঠনটির অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়। অনেকে আবার গ্রুপে গ্রুপে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। কেউ কেউ সমতল ভূমিতে ফিরে আসার চেষ্টা এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
সিটিটিসি মহানগর প্রধান বলেন, ১৫ নভেম্বর সিলেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে সাইফুলসহ তিন জন প্রথমে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাদের আরও চার ‘হিজরতকারীর’ সঙ্গে দেখা হয়। সেখান থেকে তারা বাসে করে বান্দরবানের দিকে রওনা হন। রাস্তায় তাদের ফোন ও বাসা থেকে নিয়ে আসা টাকা নিয়ে নেয় সংগঠনটির এজেন্ট। এরই মাঝখানে তাদের চুল ও দাড়িও কেটে ফেলা হয়। পরে সাইফুল ইসলাম বান্দরবানে গিয়ে দেখেন তাদের সঙ্গে একই বাসে আরও ১০ জন ‘হিজরতকারী’ এসেছিলেন। বান্দরবান থেকে তারা থানচি যান। সেখান থেকে এক রাতে ১২ ঘণ্টা হেঁটে কেএনএফের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছান।
ডিএমপির এই কর্মকর্তা জানান, ঢাকাস্থ শেরেবাংলা কৃষি ইনস্টিটিউশনের চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র মো. নাঈম হোসেন কাউকে কিছু না বলে ২ অক্টোবর ২০২২ তারিখে কুমিল্লা থেকে একইভাবে আরও আট থেকে ১০ জনের সঙ্গে থানচি হয়ে কেএনএফের প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছান।
গ্রেফতার সাইফুল ও নাঈম জানান, ক্যাম্পের যেই কক্ষে শামীন মাহফুজ থাকতেন সেখানে সশস্ত্র পাহারায় থাকতো জঙ্গি সদস্যরা। কেএনএফের প্রধান নাথান বম মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে এলে শুধু শামীম মাহফুজের কক্ষে গিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম ক্যাম্পটিতে সাত-আট দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর শামীম সিদ্ধান্ত নেন, তারা মিজোরাম সীমান্ত লাগোয়া কোনও পাহাড়ে অথবা মিজোরামের ভেতরে কোথায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করবেন। কিন্তু সেখানে যেতে না পেরে তারা ফিরে আসেন। পার্বত্য এলাকার প্রতিপক্ষ গ্রুপ এই ক্যাম্পকে কুকি-চিনের ক্যাম্প ভেবে এই হামলাও করে। পরে শামীম মাহফুজ সেখান থেকে আরেকটি পাহাড়ে গিয়ে কেএনএফ সহ মিলে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পটি করেন।
অক্টোবর মাসে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা যখন পাহাড়ে কম্বিং অপারেশন চালায় তখন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইফুল ও নাঈম হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটি মারমা গ্রামে গিয়ে ওঠেন। পরে ওই গ্রামের লোকজন তাদের ধরে কেএনএফের কাছে দিয়ে দেয়। কেএনএফ তাদের পরিচয় জানতে পেরে এক মাস নির্যাতন করে ছেড়ে দেয়। শেষে তারা সূর্যের অবস্থান ও বাড়িঘর দেখে এক মাস হেঁটে বান্দরবান শহরে এসে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। ২৫ নভেম্বরের ২০২২ তারিখে তারা বান্দরবানে আসেন। এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারিতে তাদের সন্ধান পায় সিটিটিসি। গোয়েন্দা নজরদারির একপর্যায়ে সিলেট থেকে সাইফুল ইসলাম ও ঢাকা থেকে নাঈমকে গ্রেফতার করা হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করতে পার্বত্য এলাকায় যেসব তরুণকে ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে ব্যবসার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রলোভনও দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি আকৃষ্ট করত তরুণদের। যার ফলে তারা সহজে বিপথগামী হতেন।