শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৫৫ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় মাত্র ১৭ বছর বয়সে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির সঙ্গে জড়িত হন। স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। মূলত: এই সময় থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ এই সময়ে রাঙ্গামাটিতে তৈরি হয় জুম্ম জনগণের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম জনগণের জীবনে নেমে আনে সর্বনাশের কালো থাবা। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের সকল নির্গমন দরজা বন্ধ করে দিলে ডুবে যায় রাঙ্গামাটি শহর, পাহাড়, কৃষি জমি, গ্রাম জনপদ, এমনকি তৎকালীন চাকমা রাজবাড়িও। বাঁধের ফলে ৭৭৭ বর্গ কি:মি: জনপদ প্লাবিত হয়। প্রথম শ্রেণির ৫৪ হাজার একর ধান্য জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। উদ্বাস্তু হয়ে নিরুদ্দেশ হতে হয় অসহায় জুম্ম জনগণকে। উদ্বাস্তুদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু জুম্মদের মধ্যে সে সময়কার যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা কেউ এই ঘটনায় প্রতিবাদ জানাননি। বরং উল্টো সরকারের এমন ভূমিকায় প্রশংসা করেছেন। এমন অবস্থায় সে সময়ে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে প্রচারপত্র বিলি করেছিলেন তিনি। কাপ্তাই বাঁধে বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করার জন্য ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। শুধু গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৬৫ সালে ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৬৬ সালে শিক্ষকতা দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অধিকার আদায় করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষিত জনবল। তিনি এও ভেবেছেন জাতিকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ও সংগ্রাম কোনটাই সম্ভব নয়। এই জন্য তিনি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য জনসচেতনতা গড়ে তোলেন। শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, সকল জুম্ম জনগণকে শিক্ষিত হতে হবে। অন্য জাতির লোক কখনো অজপাড়া গাঁয়ের লোকদের পড়াশুনা শেখানোর দায়িত্ব নেবে না। কাজেই নিজেদেরকে এ দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। জুম্ম জনগণ শিক্ষিত হলে প্রগতিশীল ভাবধারার লোকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আন্দোলনে সামিল হতে পারবে। সে জন্য অশিক্ষিত সমাজকে শিক্ষিত করে তোলার ওপর জোর দেন। তিনি বিশ^াস করতেন সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষিত সচেতন সংগঠিত জনগণকে নিয়েই সহজে বিপ্লব করা সম্ভব।
তিনি মনে করতেন জুম্ম জনগণ শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছে। তাই যারা পড়াশুনা করবে তারা যেন পড়াশুনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। এজন্য তিনি সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন। উদ্দেশ্য হলো শিক্ষকতা করে সমাজকে শিক্ষিত করা, সচেতন করা। তিনি মনে করতেন একমাত্র শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে জাতিকে সত্যিকারের কিছু দেওয়া সম্ভব। সে জন্য তিনি নিজেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পক্ষে তাঁর জোরালো যুক্তি ছিলো বলে তিনি যেমন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)-কেও শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে উৎসাহিত করেছিলেন। সেই সময় তাঁর সহযোগী অনেকেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি অন্যদেরকে যেভাবে সম্পৃক্ত করেছেন তেমনি নিজের ছোট ভাইকেও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। ছোট ভাইকে রাজনৈতিকভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি প্রতিনিয়ত ভূমিকা পালন করেছেন। গোটা সমাজে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত।
১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের রেলওয়ে কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি বিএড এবং ১৯৬৯ এলএলবি পাশ করেন। এলএলবি পাশ করে আইনজীবী হিসেবে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম আইনজীবী। এ সময় থেকেই মূলত তিনি পুরো মাত্রায় রাজনৈতিক ও সংগ্রামী জীবনে প্রবেশ করেন। সে বছরই বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৭০ সালের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধান রচনাকালে গণ-পরিষদের সদস্য হিসেবে এম এন লারমা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একজন আদিবাসী হিসেবে সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার সন্নিবেশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে সংসদে প্রদত্ত সংবিধান সংক্রান্ত তাঁর বক্তব্য এখনো বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশ নামক একটি ভূ-খন্ডের স্বাধীনতা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ বর্তমানেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়নি। এধরনের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার বাংলাদেশে আদিবাসী কিংবা সংখ্যালঘু জনগণের স্বাধীনতা বা আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে একেবারেই ভাবাই যায় না। যার কারণে বাংলাদেশের আদিবাসীরা “আদিবাসী” কিংবা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ইত্যাদি নামে স্বীকৃত নয়। যেহেতু সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি’ সেহেতু সংবিধানের ভাষায় তারা জাতিগতভাবে বাঙালি। সে দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের সংবিধান অসাম্প্রদায়িক কিংবা গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন করার প্রাক্কালে এম এন লারমা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পৃথক শাসনব্যবস্থাসহ জুম্ম জনগণের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দাবি করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রীয় শক্তি এম এন লারমার ন্যায্য দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। সংবিধানে সকল ধর্ম ও অবহেলিত পশ্চাৎপদ (অবাঙালি) জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা রক্ষার জন্য এম এন লারমা বারংবার আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
এম এন লারমার স্বপ্ন ছিল সংবিধানে জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের অধিকার সংরক্ষিত হবে এবং ঔপনিবেশিক অপশাসনের সকল কালাকানুন ও দমন-পীড়নের চির অবসান হবে। তাইতো তিনি সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোত্র-লিঙ্গ নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন।
লক্ষণীয় বিষয় যে, সে সময়ে গণপরিষদে উত্থাপিত এম এন লারমার বক্তব্যের প্রতি অপরাপর সম্মানিত গণপরিষদ সদস্যগণ তেমন কোন গুরুত্ব প্রদান করেননি। গণপরিষদের অনেক সদস্য তাঁকে বক্তব্য দানে বাধা প্রদান করেছিলেন। অথচ এম এন লারমার প্রতিটি কথা আজ ফলছে। তিনি বলেছিলেন, ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ সংসদ। এ স্বাধীন বাংলাদেশ সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ এই বাংলাদেশ। তাই সংবিধানে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হবে। নইলে ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের সাথে বিশ^াসঘাতকতা করা হবে। তিনি বলেছিলেন, এই সংবিধানে মানুষের অধিকার যদি খর্ব হয়ে থাকে, তাহলে আজকে ৩০ লক্ষ শহীদদের কথা স্মরণ করে, অতীতের ইতিহাসের স্মরণ করে বলেন যে, ‘ইতিহাস কাউকে কোনো দিন ক্ষমা করেনি, করবেও না। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর।’
এম এন লারমা ১৯৭২ সালে এই ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। আর কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাঁর ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে প্রতিফলিত হল। গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশাল প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলো। এক সামরিক অভ্যুত্থানে ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হল। সামরিক শাসন জারি করা হল। গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হল। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে সংশোধন করা হল। সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া হল। বহুবার সংবিধান কাটাছেঁড়া করা হলো। এক পর্যায়ে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করা হল। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হল- বর্তমান সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়ে গেল। আদিবাসীরা আদিবাসী হিসেবে বা তাদের স্ব স্ব জাতির নামে স্বীকৃতি পেল না। এসব সংখ্যালঘু অবাঙালি জাতিসমূহের উপর জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া হল।
এম এন লারমা ১৯৭২ সালে ২৫ অক্টোবর তারিখে সংবিধান বিলের উপর আলোচনা করতে যেয়ে সংবিধানের মেহনতি মানুষের অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন, রোদ বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন। রোদ বৃষ্টি মাথায় করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাদের মনের কথা এই সংবিধানে না।
১৯৭২ সালে সংবিধানের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতীসহ দেশের সকল মেহনতি মানুষের মহান নেতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে নানাভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। একদিকে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন যাপন করেছেন। সকালের অজ্ঞাতে থেকেই আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। কিন্তু তিনি অনুভব করেছেন এর মধ্যে দিয়ে আন্দোলনে তেমন কোনো ঢেউ সৃষ্টি হচ্ছে না। অথচ আন্দোলনের প্রচন্ড ঢেউ তিনি অনুভব করলেন আঞ্চলিক সীমার বাইরে। সারাদেশ ও দেশের বাইরের জনগণকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সফল হওয়া কঠিন। তাই তিনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, নীতিগতভাবে আত্মনির্ভরশীলতার নীতি গ্রহণ করা এবং কৌশলগতভাবে দেশে-বিদেশে বন্ধু তৈরি করা এবং তাদের সমর্থন আদায় করা।
এম এন লারমার মত আত্মত্যাগী ও নি:স্বার্থ মহান বিপ্লবী নেতা এই দেশের একজনকেও দেখা যায়নি। আমাদের চারদিকে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা বড় বড় বুলি আওড়ান, রাতারাতি সব কিছু বদলে দিতে চান। কিন্তু বাস্তবতাকে মোটেই বিবেচনায় নিতে চান না। দিকভ্রান্ত অতিবিপ্লবী তৎপরতার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পথে ধাবিত না হয়ে বিপথে ভুল কৌশলে কেবল নিজেদের অপচয় করেন। আর সমাজ বিপ্লবের মহান স্বপ্নকে করে তোলেন হাস্যকর অলিক বিষয়ে।
১৯৭২ সালে সংবিধানে আদিবাসীদের অধিকার সন্নিবেশিত না হওয়ায় এম এন লারমা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায়ের কথা ভাবতে থাকেন। তিনি একই বছরে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য জুম্ম জনগণের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেন। ১৯৭৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী সমাজকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করা হয়।
১৯৭৫ সালে দেশের রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন হবার কারণে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধ হলে এম এন লারমা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। এম এন লারমা সশস্ত্র সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একজন বিপ্লবীর পরিচয় দেন। তাঁর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠে। এম এন লারমার নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলন ও সংগঠনকে ধ্বংস করার জন্য দেশি-বিদেশী চক্র ষড়যন্ত্রের জালে জুম্ম জাতির মীর জাফর গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ আটকে পড়ে। এই চার কুচক্রী ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তারা জুম্ম জনগণের প্রাণ প্রিয় নেতা বিপ্লবী এম এন লারমাকে ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ রাতের আঁধারে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এম এন লারমা শহীদ হলে তাঁর ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। এম এন লারমার নির্দেশিত পথেই তিনি সশস্ত্র আন্দোলনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। আরো কিছু গণতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা করেন। যারা বাইরে থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের দাবিগুলো জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্র্তী সময়ে পাহাড়ি গণ পরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন গড়ে উঠে।
জনসংহতি সমিতি বরাবরই একদিকে সংগ্রাম, অপরদিকে সংলাপের পথ সর্বদা খোলা রেখেছিল। সে কারণে জনসংহতি সমিতির সাথে এরশাদ সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনা সরকারের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকারের সাথে ৭ বার বৈঠকের পর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে দু:খজনক যে, শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করেনি। চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব এখনো অনিশ্চিত। চুক্তির অঙ্গীকার অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে থাকবে কি থাকবে না এখনো অনিশ্চিত। জুম্ম জনগণ স্বভূমিতে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে কি পারবে না এখনো অনিশ্চিত। জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব ও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি সুরক্ষার নিমিত্তে পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি দরকার নিজেদের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য। প্রয়োজন নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন জুম্ম জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ।আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে নতুনভাবে সবকিছু মুল্যায়ন করে দেখতে হবে। প্রতিবিপ্লবী ও অতিবিপ্লবীপনা বিসর্জন দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান বাস্তবতায় পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন জোরদার করাই আমাদের একমাত্র করণীয়।
এম এন লারমাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এম এন লারমা জুম্ম জনগণের প্রতিটি মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন। এম এন লারমা বলেছেন, যে জাতি সংগ্রাম করতে জানে না, সে জাতির বাঁচার অধিকার নাই। জুম্ম জাতি সংগ্রাম করতে শিখেছে। এ জাতি সংগ্রাম করে অধিকার ছিনিয়ে আনবে-এটিই অনিবার্য। তাই মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রামী চেতনা এবং আত্মত্যাগের মহান আদর্শে বলীয়ান হয়ে জুম্ম ছাত্র-যুব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা নিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে সামিল হতে এগিয়ে আসতে হবে।
মহান বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর নীতি আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পাটি তাঁরই প্রদর্শিত পথ হতে শত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও আজও বিচ্যুত হয়নি। জুম্ম জাতি যতদিন স্বীয় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকবে ততদিন মহান বিপ্লবী এম এন লারমা চিরজীবী হয়ে থাকবেন।