বাচ্চু চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন ও বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমার) স্বপ্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি নিজের আত্মপরিচয়ের অধিকার নিয়ে, মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটা নিরাপদ আবাসভূমি গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সবকিছু জুম্ম জনগণ নিজেরাই নিজে নিয়ন্ত্রণ করবে- এধরনের একটা স্বপ্ন দেখেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, জাতিতে জাতিতে শোষণ, রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রে বৈষম্য, নারী ও পুরুষের পার্থক্য দূরীকরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে তিনি কেবলমাত্র থেমে থাকেনি, এই স্বপ্নকে বাস্তবে পূরণ করার জন্য আমৃত্যু পর্যন্ত বিপ্লবী পথে হেঁটেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র জুম্ম জনগণসহ ব্যাপক দেশপ্রেমিক অংশকে স্বপ্ন দেখিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম রচনা করেছিলেন।
জুম্ম সমাজের মধ্যে সামন্তবাদী ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির ধ্যান-ধারণা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ও রক্তের শিরা-উপশিরায় শিকড় গেড়ে বসে আছে। জুম্ম সমাজের এই ধরনের চিন্তাধারা সব সময় আমাদের প্রত্যেকের নিজের মননে ও শরীরে সক্রিয়ভাবে অবস্থান করছে। এই সমস্ত মরণ-ব্যাধি যথা সময়ে ঝেড়ে ফেলতে না পারলে জুম্ম জাতীয় জীবনের বিকাশের ধারাকে পুরোপুরি বাধাগ্রস্ত করবে। এটা কেবলমাত্র আমাদের জুম্ম সমাজের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র মানব সমাজের বিকাশের পথে এধরনের বাধাগুলো সব সময় মানুষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এম এন লারমা এটা সম্যকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই জুম্ম সমাজের মধ্যে শিক্ষা আলো জ্বালিয়ে এসব প্রগতি-বিরোধী চিন্তাধারা তাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ষাট দশকের শিক্ষিত ছাত্র-যুব সমাককে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিক্ষা আলো জ্বালাতে আহ্বান করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে নিদ্রামগ্ন জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হেঁটেছিলেন।
সেই ষাট দশকে যে সময়ে মাধ্যমিক, ইন্টারমিডিয়েট কিংবা স্নাতক পাশ করলেই সরকারি চাকরির হাতছানি দিতো ও অনায়াসে একটা সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া যেতো, সেই সময়ে সেই প্রথাগত স্রোতের দিকে না হেঁটে জীবনের সুন্দর সম্ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে তরুণ এম এন লারমা সংগ্রামের অনিশ্চিত পথ বেছে নিয়েছিলেন তো বটেই, তাঁর বিপ্লবী গুণাবলীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকেও উদ্বুদ্ধ করে সেই কন্টকাকীর্ণ পথে চালিত করেছিলেন।
১৯৬০ সালে জুম্ম জনগণের মরণফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের মাধ্যমে যখন জুম্ম জাতীয় জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটা চলছিল, তার প্রতিবাদ করতে জুম্ম জনগণের সামন্ত নেতৃত্ব কিংবা কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বে সাহস দেখাতে পারেনি, সেখানে মাত্র ২৩ বছরের তরুণ এম এন লারমা জেল-জুলুমের ভয়কে তোয়াক্কা না করে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। এ ধরনের প্রতিবাদ করা হয়তো বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনেকের স্বাভাবিক হতে পারে, কিন্তু সেই সময়কার ঘুঁণেধরা জুম্ম সমাজের এমন একজন অল্প বয়সী তরুণের পক্ষে প্রতিবাদ করা চাট্টিখানি কথা নয়। সেটা কেউই পারেননি, পেরেছিলেন একমাত্র এম এন লারমা। কেননা তিনি আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা এক জুম্ম জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এম এন লারমা ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মাত্র ৩১ বছর বয়সে। খুব সম্ভবত সেসময় তৎকালীন গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিনিই হয়তো সর্বকনিষ্ঠ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে দেশের সংবিধান রচনার সময়ও মাত্র ৩৩ বছর বয়সে গণপরিষদে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তথা আপামর দেশবাসীর পক্ষে যে তীক্ষ ও শাণিত বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তা সত্যিই কল্পনাকেও হার মানায়। বিশেষ করে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী সেসময়কার বাঙালি জাতীয়তাবাদী শাসকগোষ্ঠীর মুখের উপর “আমি বাঙালি নই” উচ্চারণ করা কিংবা “একজন চাকমা যেমন বাঙালি হতে পারে না, তেমনি একজন বাঙালিও চাকমা হতে পারে না” বলে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়া কারোর পক্ষে সাহস করা কখনোই সম্ভব ছিল না, যদি না তিনি একটা গভীর স্বপ্ন ও আদর্শকে ধারণ করে বিপ্লবী সংগ্রামে অবিচল থাকতে না পারেন।
বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন ব্যাপক জুম্ম ছাত্র-যুবকদের দেখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে এম এন লারমা স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক জুম্ম জনতাকে অধিকতর সংগ্রামী ও ত্যাগের প্রেরণা নিয়ে সংগ্রামের ময়দানে এগিয়ে আসতে হবে। বলা অপেক্ষা রাখে না যে, এম এন লারমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে আজও অবিরাম হেঁটে চলেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে অগ্রগামী জুম্ম ছাত্র-যুবকরা। তাঁর স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজকে নিরলসভাবে আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। লারমার দেখানোর স্বপ্ন ও বর্তমান জুম্ম তরুণদের স্বপ্নকে একাকার করে এক ও অভিন্ন ধারায় মিলন ঘটিয়ে পাহাড়ের বুকে স্বপ্নের সেতু নির্মাণ করতে হবে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছিলেন চিন্তাধারার দিক থেকে উচ্চমাপের এক বিপ্লবী নেতা। রাজনৈতিক জীবনে কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ কারিগর। তাঁর প্রদর্শিত আদর্শের উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে আন্দোলন সংগ্রামের নীতি, কৌশল নির্ধারিত হয়েছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে লক্ষ্য পরিপূরণের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ১৯৭২ সালে জুম্ম জনগণের সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় একটা রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করেন তিনি। এই সংগঠনের পতাকাতলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহকে একত্রিত করতে গিয়ে এম এন লারমাকে পাহাড়ের মানুষের নিকট নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তারপরও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতিকে জুম্ম জনগণের আশুলক্ষ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য পরিপূরণের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত করেন তিনি। সেই সংগঠনের পতাকাতলে সমবেত হয়ে ৬০-৭০ দশকের জুম্ম ছাত্র-যুবকরাই ঝাঁকে ঝাঁকে আন্দোলন-সংগ্রামে নির্ভীকচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিশাল সাংগঠনিক প্রতিভা, জুম্ম জনগণের প্রতি অপরিসীম আস্থা ও অসাধারণ সামরিক দক্ষতায় সমস্ত বাধা-বিপত্তি লংঘনে সক্ষম হয়েছেন। যেখানে জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রাম সেখানে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নির্ভীক ও দৃঢ়চিত্তে নিজেকে অধিকতর সংগ্রামী ও ত্যাগীরূপে আত্ম-প্রকাশ করেছেন। এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রামের স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে এম এন লারমার সেই ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও অবদানের কথা উঠে এসেছে। সেইসব স্মৃতিচারণমূলক লেখা ও প্রবন্ধ, সংগ্রামের অনুপ্রেরণামূলক লেখা, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণমূলক লেখা, জ্ঞানগর্ভ ও পান্ডিত্যপূর্ণ লেখা জুম্ম জাতির মুক্তির সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
৭০ দশকের সময় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জুম্ম জনগণের পশ্চাৎপদতার বিষয়টি মাথায় রেখে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছেন। প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই সময়ের যৌক্তিক দাবিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি প্রত্যাখান করেন। ৮০ দশকের সময় জাতীয় রাজনৈতিক দামাদোলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক শারিরীক ও মানসিক উভয়ই প্রকার নির্যাতন থেকে বাঁচবার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জুম্ম জনগণ নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে গভীর জঙ্গলে কিংবা প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সময় এম এন লারমা জুম্ম সমাজের ব্যাপক দেশপ্রেমিক ও সবচেয়ে অগ্রগামী অংশকে সাথে নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি জুম্ম জনগণের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের রূপরেখা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার আলোকে তৈরি করেছিলেন।
সেই সময়টিতে তাঁর কি কি কর্মসূচি নিতে হবে, কোন অবস্থায় ঠিক কোন পদক্ষেপটা গ্রহণ করলে সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তিকে একত্রিত করে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে মরণ আঘাত হানা যাবে- সেটিই ঠিকমত বুঝেসুঝে আন্দোলন সংগ্রামের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করে নিয়ে ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম তিনি জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটা সঠিক, সুস্পষ্ট ও সময়োপযোগী কর্মসূচি হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন। সামরিক কার্যক্রমের অগ্রগতির পাশাপাশি ধীরে ধীরে জনসংহতি সমিতির পাশাপাশি যুব সমিতি, মহিলা সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত ও মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে পাহাড়ের চারিদিকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক উভয়ই কার্যক্রম সমানতালে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে এক পর্যায়ে জুম্ম জনগণের সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় সংগঠন হিসেবে জনসংহতি সমিতির সুনাম দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এম এন লারমার প্রদির্শত জুম্ম জনগণের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ত্যাগের ভেতর দিয়ে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য শাসকগোষ্ঠীর আজও কোন সদিচ্ছা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তিভূমি। এই চুক্তিকে নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্র ও নানান তালবাহানার কোন শেষ নেই। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী পুরোপুরি ধূলিসাৎ করে চলেছে। শাসকগোষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য ইতিমধ্যে আরও বেশি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, নানারকম তালবাহানা করে সময় কাটানো, জুম্ম জনগণের প্রাণের দাবিগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া আর পাহাড়ের অভ্যন্তরীনে লুকিয়ে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভেদপন্থী সৃষ্টি করে ‘ভাগ কর, শাসন কর’-এই জঘন্য নীতি প্রয়োগ করে আন্দোলনের মূলশক্তিকে দুর্বল করে জুম্ম জনগণের সবচেয়ে অগ্রগামী ও প্রগতিশীল শক্তির উপর আঘাত হানা।
শাসকগোষ্ঠীর এধরনের দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র তখনই গুড়িয়ে দিতে পারবো যদি ষাট ও সত্তর দশকে তরুণ বয়সে এম এন লারমা যেভাবে অসীম সাহসিকতায় শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, সেভাবে বর্তমান তরুণ সমাজও লারমার স্বপ্ন ও আদর্শ ধারন করে জুম্ম জনগণের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে এগিয়ে আসে।
সকল বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে আমাদের জুম্ম জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। সমাজের মধ্যে সামন্তবাদী ও সংগ্রাম বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা সক্রিয় থাকার কারণে জুম্ম সমাজের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি ব্যাপক জুম্ম জনগণ এখনও উদাসীন হয়ে রয়েছে। নিজেকে জানার মতো আগ্রহ এখনও প্রচুর পরিমাণে অভাব দেখা যায়, ব্যাপক জুম্ম জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা এখনও জাগ্রত হতে পারেনি। অথচ, বর্তমান পাহাড়ের রাজনৈতিক অবস্থার বাস্তব চাল-চিত্র বিচার-বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে ওঠে আন্দোলন সংগ্রাম করার মতো একটা বাস্তব পরিস্থিতি ও অবস্থা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে।
প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবিত অবস্থায় আন্দোলন সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো সমগ্র নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তি। সেই স্বপ্ন পূরণে পাহাড়ের ব্যাপক জুম্ম জনগণকে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এম এন লারমার সারা জীবনের ত্যাগ ও সংগ্রামের ফসল হলো বর্তমানে ব্যাপক জুম্ম ছাত্র ও যুব সমাজের অগ্রগামী একটা অংশ। এই অগ্রগামীরাই প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্ন পূরণের মহান উদ্দেশ্যকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের ব্যাপক জুম্ম জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনায় আন্দোলন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমি এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্বিধাবিভক্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোকে জিইয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে তার জন্য দেশের আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও পাহাড়ের প্রতিক্রিয়াশীল পঞ্চম বাহিনী- চুক্তির আগের ন্যায় শোষণের পুরানো যন্ত্র জিইয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী যতই দমন-পীড়ন চালাবে ততই আমাদের সংগ্রামী চেতনা আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিয়তই লাগামহীন অত্যাচার, অবিচার, নিজ ভূমি হতে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, নারীর উপর সহিংসতা, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা ইত্যাদি অসংখ্য অমানবিক ও কলঙ্কজনক ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। শাসকগোষ্ঠীর এই দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এই সংগ্রাম রচনা করতে গিয়ে এম এন লারমাকে প্রচুর শ্রমের মূল্য দিতে হয়েছে, জুম্ম সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা করে সেগুলির সমাধান খুঁজে বের করতে হয়েছে। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জীবনদর্শন হিসেবে সত্যিকার অর্থে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজের জুম্ম সমাজের অবস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবস্থা বুঝবার জন্য প্রচুর অধ্যয়ন-অনুশীলন করেছেন।
এম এন লারমার এই নিরলস প্রচেষ্টা ও সুকঠিন সংগ্রাম জুম্ম জনগণের মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। তিনি জুম্ম জনগণের চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগ ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে আন্তরিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করতেন এবং তাঁরই হাতেগড়া রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির কর্মীদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের জয় সম্পর্কে তাঁর অগাধ বিশ্বাস, গভীর জ্ঞান, অপূর্ব সাংগঠনিক শক্তি, জুম্ম সমাজের অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা, অমায়িক ব্যবহার প্রভৃতি গুণের জন্য প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একজন জুম্ম জাতির মুক্তির সংগ্রামে নেতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এখান থেকে বুঝা যায় যে, এম এন লারমার স্বপ্ন ছিল অনেক উঁচুতে ও অনেক ব্যাপকতায়। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বপ্ন চির জাগরুক হয়ে থাকবে!