হিল ভয়েস, ৭ অক্টোবর ২০২২: ভূমি দখল, ভূমি উচ্ছেদ, আদিবাসীদের প্রতি অত্যাচার। সেটা প্রতিদিনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্রের যে জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার সেটা লক্ষ্য করা যায় না। রাবার কোম্পানির জমি ইজারা বাতিল না করায় পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন।
আজ শুক্রবার (৭ অক্টোবর ২০২২) সকাল ১১টায় ‘সংকটে লামার তিন জুমিয়া পাড়া’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনায় তিনি এই কথা বলেন। আদিবাসীদের অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আইপিনিউজ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই অনলাইন আলোচনা সভার সঞ্চালনা করেন আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি ম্যাথিউ চিরান।
জাকির হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, “প্রত্যেকটি মানুষেরই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। পাহাড়ে যখন আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াই চলছিল তখন বর্তমান সরকার একটি সমঝোতায় এসেছে। সেই সমঝোতার ভিত্তিতেই ১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির যদি বাস্তবায়ন হতো, তাহলে আজকে এই সমস্যার উদ্ভব হত না। পাহাড়ের ভূমি কমিশন এবং ভূমি বিরোধ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। যেটা চুক্তি অনুযায়ী নিষ্পত্তি হওয়ার কথা ছিল। যদি সেটা হতো তাহলে আজকে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। কাজেই, এখানে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির একটা সমস্যা আমরা লক্ষ্য করছি।”
আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, “২০১০ সালে যখন সংবিধান পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হলো, সেসময় আদিবাসীদের স্বীকৃতি পুরো মাত্রায় আসেনি। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি আছে। বৈচিত্রের প্রতি আমাদের সম্মান দিন দিন কমে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি আমাদের ঘৃণাসূচক বাক্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “ভূমি দখল, ভূমি উচ্ছেদ, আদিবাসীদের প্রতি অত্যাচার আমরা প্রতিদিনই লক্ষ করছি। সেখানে রাষ্ট্রের যে জোরালো ভূমিকা থাকা দরকার সেটা আমরা লক্ষ্য করি না। রাবার কোম্পানির জমি ইজারা বাতিল না করাটা পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন করা হয়েছে। খাদ্যশস্য পুড়িয়ে দেয়া, পানিতে বিষ মিশিয়ে দেয়া এগুলো ক্রিমিনাল অফেন্স। কিন্তু এগুলো যারা করেছে তারা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে আমরা কোন ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজিম তিতিল বলেন, “সারা বাংলাদেশেই জমিগুলো সাধারণ মানুষের হাতে নেই। বাংলাদেশকে বসবাসযোগ্য করেছেন বহু জাতির মানুষ। কিন্তু আজকে এই জমিগুলো বিভিন্ন কর্পোরেশন, ক্ষমতাধর এবং উচ্চবিত্তদের কাছে আছে। সাধারণ মানুষকে ছিন্নমূল করার যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়ার অংশ হচ্ছে আদিবাসীদেরকে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা। আদিবাসীরা যেসব জায়গা বসবাসযোগ্য করেছিলেন, সেসব জায়গাগুলো থেকে তাদেরকে বারবার উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদেরকে বারবার স্থানান্তরে বাধ্য করা হচ্ছে।”
রাষ্ট্রের দর্শন নিয়ে তিনি আরো বলেন, “এখানে একটি দর্শন রয়েছে। সেই দর্শনটা হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক মানুষ বাস করে। সবার সমান অধিকার আছে এবং সবাই সব জায়গায় থাকবে। কিন্তু এই দর্শনটি আসলে বাস্তব সম্মত নয়। কেননা সমতল থেকে যেসব মানুষকে আমরা পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করালাম, সে মানুষটা কিন্তু পাহাড়কে বুঝে না। সে মানুষটা কিন্তু পাহাড়ের বসবাস রীতি সম্পর্কে জানেন না।”
এদিকে লামার সরই ইউনিয়নের স্থানীয় ম্রো যুবক প্রেন সাই ম্রো বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, “গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাবার কোম্পানির লোকজন কলাই ঝিরিতে বিষ প্রয়োগ করে। এই ঝিরির পানি আশেপাশের তিনটি গ্রামের মানুষ ব্যবহার করত। বিষ প্রয়োগের পর প্রায় ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত ঝিরির পানি খাওয়ার অযোগ্য ছিল। এই সময়ে গ্রামবাসীর শুধুমাত্র বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। অল্প পরিমাণ পানির সবাই ভাগাভাগি করে খাওয়া শুরু করেছিল। পরবর্তীতে ২৬ সেপ্টেম্বর রেং ইয়ুঙ ম্রোর তিনশত কলাগাছ আবার কোম্পানির লোকজন কেটে ফেলে। ওই জায়গাতেই ২০২১ সালে বিভিন্ন ফলজ গাছে ছিল কিন্তু সেগুলোও রাবার কোম্পানি কেটে দিয়েছিলো।”
মামলা এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, “আমাদের ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তারা বাড়িতে থাকতে পারছে না। অনেকেই লুকিয়ে থাকছে। পুলিশের আটক করার ভয়ে গ্রামের মানুষ বাজারে যেতেও ভয় পাচ্ছে।”
উল্লেখ্য যে, বান্দরবানের লামায় রেং ইয়েন পাড়ার একমাত্র পানির উৎসে গত ৬ সেপ্টেম্বর বিষ প্রয়োগ করে লামা রাবার কোম্পানি’র শ্রমিকরা। এদিকে গত ২৪ এপ্রিল ইজারা নেয়া হয়েছে এমন দাবিতে ডলুছড়ি মৌজার ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০০ একর জুম ভূমির ফসল ও গাছপালা পুড়িয়ে দেয় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি।। এছাড়াও রেং ইয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার বাসিন্দা রেং ইয়ুং ম্রোর রোপণ করা প্রায় ৩০০ টি কলাগাছ কেটে ফেলার ঘটনা ঘটে।