হিল ভয়েস, ২১ অক্টোবর ২০২২, বান্দরবান: পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী কেএনএফ এর ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া”র ৭ জন ও বমপার্টি খ্যাত সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর ৩ সদস্য সহ মোট ১০ জনকে আটক করেছে র্যাব। এসময় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
শুক্রবার (২১ অক্টোবর) বেলা ১২:০০ টায় বান্দরবানের মেঘলাস্থ পার্বত্য জেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে র্যারের এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান র্যাবের সহকারী পরিচালক লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং লে: কর্নেল খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা থেকে বেশ কয়েকজন তরুণ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। র্যাব উক্ত বিষয়ে নজরদারী বৃদ্ধি করে। র্যাবের গোয়েন্দারা জানতে পারে যে, আরো বেশ কিছু তরুণ ঘর ছেড়ে উগ্রবাদের উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। র্যাবের গোয়েন্দা দল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ৪ তরুণকে আটক করে। পরে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব।
গত ৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিখোঁজ ৪ তরুণ ও উগ্রবাদী সংগঠনের দাওয়াতী, তত্ত্বাবধান, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় প্রদান ও অন্যান্য কার্যক্রমের সাথে জড়িত ৩ জনসহ মোট ৭ জনকে আটক করে র্যাব। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ি ও কেরানীগঞ্জ হতে উগ্রবাদী সংগঠনটির দাওয়াতী ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ ও নিরুদ্দেশ ৩ জনসহ মোট ৫ জনকে আটক করে র্যাব।
আটককৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানান, হরকতুল জিহাদ (জেএমবি) এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। এই সংগঠনটি ২০১৯ সালে “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) নামে নামকরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। হুজিবি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে সদস্য ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছিল বিধায় তারা সংগঠন থেকে বের হয়ে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে।
আটককৃতরা র্যাবকে আরো জানায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ছত্রছায়ায় দুর্গম অঞ্চলে আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বিভিন্ন নাশকতা ও সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনাসহ সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বিগত কয়েকদিন যাবৎ বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে র্যাব-এর নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়। গত ৯ অক্টোবর থেকে রাত থেকে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে।
বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) রাতে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির সাইজামপাড়া ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজার এলাকায় র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার নেতৃত্বে র্যাব-৭ ও র্যাব-১৫ অভিযান পরিচালনা করে। এসময় পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী কেএনএফ ক্যাম্প থেকে নিম্নোক্ত জঙ্গি সদস্যদের আটক করা হয়-
(১) সৈয়দ মারুফ আহাম্মদ প্রকাশ মানিক (৩১), পিতা-সৈয়দ আবুল কালাম, থানা-জগন্নাথপুর, জেলা-সুনামগঞ্জ।
(২) ইমরান হোসাইন শাওন (৩১), পিতা-মোঃ শাহআলম, থানা-স্বরূপকাঠি, জেলা-ফিরোজপুর।
(৩) কাওসার শিশির (৪৬), পিতা-গোলাম কিবরিয়া, থানা-শৈলকুপা, জেলা-ঝিনাইদহ।
(৪) জাহাঙ্গীর আহাম্মদ জনু (২৭), পিতা-ফজলুল হক, থানা-বিয়ানিবাজার, জেলা-সিলেট।
(৫) মোঃ ইব্রাহীম আলী (১৯), পিতা-নয়ন মৃধা নুরুজ্জামান, থানা-মুলাদি, জেলা-বরিশাল।
(৬) আবু বক্কর ছিদ্দিক বাপ্পি (২৩), পিতা-আতিকুল আলম, থানা-গোলাপগঞ্জ, জেলা-সিলেট।
(৭) রুফু মিয়া (২৬) পিতা-আব্দস সালাম, থানা-চাতক, জেলা-সুনামগঞ্জ।
আর আটককৃত জঙ্গী আশ্রয়দাতা কেএনএফ সদস্যরা হচ্ছেন- (১) জৌথান স্যাং বম (১৯), পিতা-লাল মুন সয় বম, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান; (২) ষ্টিফেন বম (১৯), পিতা-লাল মিন সম বম, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান এবং (৩) মাল সম বম (২০), পিতা-জিক বিল বম, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান।
এসময় তাদের ক্যাম্প থেকে এসবিবিএল বন্দুক ৯টি, গুলি ৫০ রাউন্ড, কার্তুজ কেইস ৬২টি, লম্বা বন্দুক ৬টি, কার্তুজ কেইস ১টি, কার্তুজ বেল্ট ২টি, বিদেশী পিস্তল ১টি এবং বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র, ওয়াকিটকি, পোষাকসহ নানান সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র্যাব আরো জানায়, এই অভিযান বিশেষ কোন জাতিগোষ্ঠির বিরুদ্ধে নয়। এই অভিযান ছিল সমতল থেকে এসে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ক্যাম্পে ট্রেনিং নেয় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের বিরুদ্ধে। র্যাব এর অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।
গ্রেপ্তারকৃত বমপার্টির তিনজন সদস্য জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার উপদেষ্টা শামীম মাহফুজের সঙ্গে নাথান বমের একটি চুক্তি হয়। ২০২১ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত জঙ্গি সদস্যদের বমপার্টির গোপন আস্তানায় প্রশিক্ষণ প্রদান করার কথা। এর বিনিময়ে জঙ্গিরা বমপার্টিকে মাসিক তিন লাখ টাকা এবং বমপার্টির সদস্যদের সমস্ত খরচ বহন করবে।
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার রাইক্ষ্যং ও বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলার সাইজাম পাড়া, শিপ্পি পাহাড়, রনিন পাড়াসহ কেউক্রাডং পাহাড়ের আশেপাশের এলাকায় সেনাবাহিনী ও র্যাবের সন্ত্রাস বিরোধী চিরুনি অভিযান চলছে। সমতল এলাকার একটি জঙ্গি সংগঠন পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এমন খবরের ভিত্তিতে যৌথবাহিনী এই অভিযান শুরু করছে।
অভিযানে সেনাবাহিনীর সহস্রাধিক সেনা ও র্যাবের সদস্যরা অংশ নেয়। অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহার করা হয়। দুর্গম এলাকায় এই অভিযানে প্যারা মিলিটারি সদস্যরাও অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এটি পাহাড়ে সন্ত্রাস বিরোধী বড় অভিযান বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, র্যাব কর্তৃক আটককৃত উক্ত ১০ জনকে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানায় সোপর্দ করা হয়েছে এবং ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা নং-২, তারিখ-২১/১০/২০২২।