হিল ভয়েস, ১১ অক্টোবর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে নতুন ইসলামী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’-এর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে বলে জানা গেছে। আর্থিক সহায়তার বিনিমিয়ে ‘স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন’ এই জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। শুধু অস্ত্র-প্রশিক্ষণই নয়, জঙ্গিদের বোমা তৈরি ও থাকা-খাওয়ার সুবিধাও করে দিচ্ছে তারা।
স্থানীয় কোন সন্ত্রাসী সংগঠন এসব জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে সেনা-মদদপুষ্ট বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ‘জামায়াতে আরাকান’ নামে একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্টপোষকতায় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী পরিবেশ বলবৎ থাকায় রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলো অবাধে তাদের গোপন আস্তানা ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গতকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) ঢাকার কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে কিছু বিচ্ছিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় নিখোঁজদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে তাঁরা নতুন ওই জঙ্গি সংগঠনের নামেই অবস্থান করছেন।
তিনি আরো বলেন, জঙ্গিদের ধরতে বিশেষ করে পাহাড়ে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে তাদেরকে নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবের হেলিকপ্টার টহল দিতে শুরু করেছে বলে তিনি জানান।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, নব্য জেএমবি, হিজবুত তাহরীরের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয় নামে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটি। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও দুইবছর পর নতুন নামকরণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে আর্থিক সহায়তা এবং মাদ্রাসা-মসজিদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলে তহবিল সংগ্রহ করছে এই জঙ্গি সংগঠনটি।
নতুন জঙ্গি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়’ তাদের কার্যক্রম পাহাড় কেন্দ্রিক পরিচালনা করছে। নিজেরা নিরাপদে থেকে সামরিক প্রশিক্ষণের কৌশল হিসেবেই পাহাড়কে বেছে নিয়েছে সংগঠনটি।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ১৯ জেলা থেকে ৫৫ তরুণ নিরুদ্দেশ হন। নিরুদ্দেশ যুবকদের মধ্যে ৩৮ জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেছে র্যাব। যারা প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। তবে পরিবারগুলোর দাবি, তাদের সন্তান বিদেশে আছেন। তারা প্রতি নিয়মিত পরিবারের কাছে অর্থও পাঠাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ছয় তরুণসহ মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গত বুধবার ও রবিবার পৃথক অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হাবিবুল্লাহ কুমিল্লায় কুবা মসজিদে ইমামতি করতেন। এছাড়া তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের নাইক্ষংছড়িতে তিনি প্রায় দুই বছর যাবত একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র সংগ্রহ করে তার মাদ্রাসায় রাখতেন। ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণে পাঠিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৩৮ জনের নাম পেয়েছে র্যাব। ‘জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে’ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া যুবকরা পাহাড়ি এলাকায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের অনেককে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়ার প্রশিক্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে সমন্বিত অভিযান চলছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী প্রীতিবিন্দু চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় রাষ্ট্রীয় পলিসি হচ্ছে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা। স্বভাবতই প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের তরফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন ও ইসলামী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্টপোষকতা প্রদান করা হয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী ও বিজিবির ছত্রছায়ায় রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরএসও, আরসা, আলিকান, জামায়াতে আরাকান সক্রিয় রয়েছে। এসব জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে সেনাবাহিনী ও বিজিবি বরঞ্চ তারদেকে আশ্রয়, বেইস ক্যাম্প স্থাপন এবং কৌশলগত সহায়তা প্রদান করে আসছে বলে অভিযোগ করেন মি. চাকমা। এছাড়া এসব রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে বলে এযাবত্ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে।
রুমা উপজেলায় নিরাপত্তার খাতিরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনপ্রতিনিধি জানান যে, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের প্রাক্তন সদস্য শামীম মাহফুজের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে আরাকানের জঙ্গীরা বান্দরবানের রুমা উপজেলার রেমাক্রী-প্রাংসা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট বম পার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর আস্তানায় একসাথে অবস্থান করে থাকে। বম পার্টি সশস্ত্র সদস্যরা তাদের ক্যাম্পে জামায়াতে আরাকান জঙ্গীদেরকে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং চীন-মায়ানমার সীমান্ত থেকে জামায়াতে আরাকানের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করবে এবং পক্ষান্তরে জামায়াত আরাকান বম পার্টিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে মর্মে জামায়াতে আরাকান ও কেএনএফের মধ্যে একটি চুক্তিতে অবতীর্ণ হয়েছে বলে জানান উক্ত জনপ্রতিনিধি।
রুমার রেমাক্রি প্রাংসা এলাকায় অবস্থান সত্ত্বেও সেনাবাহিনী, বিজিবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা প্রশাসনের তরফ থেকে জামায়াতে আরাকান কিংবা বম পার্টি খ্যাত কেএনএফের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বরঞ্চ নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ প্রদান করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
অপরদিকে সেটেলারদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’কে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী পৃষ্টপোষকতা ও মদদ দিয়ে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শত্রু-ভাবাপন্ন সম্পর্ক হলেও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় পলিসি বাস্তবায়নে এসব জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদে কাজ করতে দেখা যায়। এমনকি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের সদস্যদেরকে আওয়ামীলীগ-বিএনপি সদস্যদের সাথে এই নাগরিক পরিষদে একসাথে কাজ করে আসছে।