হিল ভয়েস, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাঙ্গামাটি: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বৈঠক বাতিলের দাবিতে সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের মদদপুষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের ৩২ ঘন্টা হরতাল কর্মসূচির নিন্দা জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিট ।
আজ মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির পাঠানো এক প্রেস বিবৃতিতে নিন্দা জানান সংগঠনটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান।
প্রেস বিবৃতিতে গৌতম দেওয়ান বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। কমিশন সৃষ্টি হওয়ার প্রায় দুই যুগ পরেও এই কমিশন নানান কারণে তার ন্যূনতম অভীষ্ট লক্ষ্যও অর্জন করতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ কমিশনের কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের কতিপয় জাত্যভিমানী ও পাহাড়ি বিদ্বেষী বাঙালি সংগঠনসমূহের প্রতিনিয়ত বাধাপ্রদান, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।”
তিনি আরো বলেন, “দীর্ঘ আড়াই বৎসর পরে রাঙামাটিতে ৭ সেপ্টেম্বরে কমিশনের বৈঠকের বাধাদানের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ নামধারী সংগঠনের হরতাল আহবান ও এর সাম্প্রদায়িক মনোভাবপ্রসূত ৭ দফা দাবিনামার বিরুদ্ধে আমরা তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি।”
উল্লেখ্য, গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য ভূমি কমিশনের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখের বৈঠক প্রতিহত করাসহ ৭ দফা দাবিতে ৬ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ৬:০০ টা থেকে ৭ সেপ্টেম্বর (বুধবার) দুপুর ২:০০ টা পর্যন্ত রাঙ্গামাটি শহর এলাকায় টানা ৩২ ঘন্টা হরতালের ডাক দেয়।
এরপর আজ (৬ সেপ্টেম্বর) ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সচিব মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন স্বাক্ষরিত এক পত্রে ভূমি কমিশনের উক্ত তারিখের সভা স্থগিত করার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। পরে দুপুরের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদও তাদের আহুত হরতাল বিকাল ৩:০০ টা থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।
সেটেলারদের হরতালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা:
বিএনপি’র সমাবেশের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি হলেও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আহুত হরতালে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর নজিরবিহীন সহযোগিতা ও উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
বিএনপি যেখানেই সমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা করেছে সেখানেই সমাবেশ ভণ্ডুল করার জন্য জেলা প্রশাসন রাঙ্গামাটি জেলার একের পর এক উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করে চলেছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের পূর্ব-নির্ধারিত সরকারি বৈঠক ভন্ডুল করার সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে আহুত পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের হরতালে নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের প্রতি সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতা ও সমর্থন থাকায় ভূমি কমিশনের একটি সরকারি কর্মসূচির বিরুদ্ধে আহুত হরতালের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরঞ্চ রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা প্রদান করা হয় বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার জাতীয় পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র শিবির এবং খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপির বিরুদ্ধে সক্রিয় হলেও সেসব সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদে সক্রিয় রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায় পার্বত্য গণ পরিষদ, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ, বাঙালি ছাত্র ঐক্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন ইত্যাদি বাঙালি মুসলিম সেটেলারদের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক কয়েকটি সংগঠনকে বিলুপ্ত করে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর সহায়তায় মুসলিম বাঙালি সেটেলারদের একক সংগঠন হিসেবে পার্বত্য চট্রগ্রাম নাগরিক পরিষদ গঠন করা হয়।
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং ভূমি বেদখল, জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণে সংগঠিত করার লক্ষ্যেই সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই বাঙালি মুসলিম সেটেলার ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্টপোষকতা ও সমর্থন দিয়ে চলেছে।
তারই অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর গঠিত হওয়ার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ পার্বত্য ভূমি কমিশনের ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে আহুত বৈঠকের বিরুদ্ধে সড়ক অবরোধ করে। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আহুত ভূমি কমিশনের সভাও ঘেরাও অনুষ্ঠান করে এই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এ সময়ে নাগরিক পরিষদের প্রতিবাদকারীদের প্রতিরোধ না করে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী তাদের প্রতি প্রকারান্তরে সমর্থন ও মদদ দিয়েছিল বলে প্রত্যক্ষ করা গেছে।
আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত-শিবির, জাতীয় পার্টি সমন্বয়ে গঠিত এই নাগরিক পরিষদ:
সরেজমিন তদন্তে জানা গেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের বান্দরবান জেলার অধিকাংশ নেতা-কর্মীই বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্র শিবির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামী ছাত্র শিবিরের বান্দরবান জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো: মিজানুর রহমান আখন্দ এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতা।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের বান্দরবান জেলা কমিটির সভাপতি কাজী মজিবুর রহমান বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আলিকদম উপজেলা শাখার সভাপতি মোঃ আবুল কালাম হচ্ছেন বিএনপির আলিকদম উপজেলা শাখার সভাপতি ও আলিকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের অঙ্গ সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা সভাপতি মোঃ নাজিম আল হাসান ইসলামী ছাত্র শিবির রাজনীতির সাথে যুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের অধিকাংশ নেতাই শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের ব্যানারে তারা গোপনে শিবিরের প্রচার-প্রচারণা চালায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সহ প্রচার সম্পাদক পারভেজ আহম্মেদ শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানা যায়। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সহ প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মো: ইব্রাহীম খলিল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল হোসাইন জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।