হিল ভয়েস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকা: অবিলম্বে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার মূল আসামীদের গ্রেফতার করা এবং যথাযথ তদন্ত করে এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় প্রজাসত্ব আইনের ৯৭ ধারা যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় আদিবাসী মুন্ডাদের জমি ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছে ৭টি মানবাধিকার সংগঠন।
আজ বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর ২০২২) বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, কাপেং ফাউন্ডেশন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, নাগরিক সমাজ প্রভৃতি সংগঠন নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যা এবং সাতক্ষীরায় আদিবাসীদের জমি দখল নিয়ে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আহুত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানায়।
সংবাদ সম্মেলনে ধুমঘাট এলাকার মুন্ডা পরিবারগুলোর জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; আদিবাসীদের যেসব জমি জাল দলিলের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে দখল করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেইসব জমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া; নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার খরচসহ ক্ষতিপূরণ করা; সারা দেশে আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘন বন্ধ করতে হবে এবং দুস্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা; অবিলম্বে মুন্ডাসহ সমতলের আদিবাসীদের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুত ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করাসহ ৮টি দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ৭টি সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সঞ্জীব দ্রং এবং কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয় যে, গত ১৯ আগস্ট ২০২২ জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট অন্তাখালী মুন্ডা পল্লীতে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী মহলের হামলায় ১২ জন মুন্ডা আদিবাসী আহত হন। আহতদের মধ্যে নরেন্দ্র নাথ মুন্ডা পরের দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। নিহতের ভাইয়ের ছেলে ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা ২২ জন আসামীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো ১৬০ থেকে ১৭০ জনকে আসামী করে ২০ আগস্ট শ্যামনগর থানায় মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনার খবর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রচারিত হয়। এই হত্যা ও হামলার প্রতিবাদে স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সমাজ সোচ্চার হয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন ও নাগরিকগণ ২৯ আগস্ট ২০২২ আদিবাসী মুন্ডাপল্লী ধুমঘাট, শ্যামনগর এলাকায় সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধানে যান। যৌথ নাগরিকদের পক্ষে এই টীমে ঐ এলাকার সাধারণ মানুষ, এনজিও এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। ঢাকা থেকে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, কাপেং ফাউন্ডেশনের পল্লব চাকমা, এএলআরডি’র রফিকুল ইমলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরিন কনা, সংবাদিক হাসান হাবিব, ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সাজ্জাদ, স্বদেশ-এর মাধব চন্দ্র, সামস্-এর কৃষ্ণপদ মুন্ডা, হেড-এর লুইস রানা গাইনসহ এএলআরডি’র সহযোগী সংস্থা ও স্থানীয় নাগরিক সমাজ অংশ নেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় যে, শুধু মুন্ডা আদিবাসী বা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নন, দেশের যে কোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ধুমঘাট এলাকার মুন্ডাপল্লীর হত্যাকান্ড একটি পরিকল্পিত হত্যা, যার মধ্য দিয়ে সেখানকার সংখ্যালঘু জনগণ চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে এই হামলার কারণে এখনো সেখানে বাসিন্দাদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। আতংকের মূল কারণ, প্রধান আসামীদের কেউই এখনো গ্রেফতার হয়নি।
সরেজমিন পরিদর্শনের গিয়ে নাগরিত প্রতিনিধিদল অবগত হয়েছেন যে, ঘটনার দিন ২৯ আগস্ট সকালে ভূমিগ্রাসীচক্র স্থানীয় ভাড়াটে সন্ত্রাসী দল জড়ো করে দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে গ্রামের দুইদিক থেকে চলাচল ও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। একপ্রকার মুন্ডাদের অবরুদ্ধ করে সন্ত্রাসীর দল মুন্ডাপাড়ায় হামলা চালায়। আনুমানিক সকাল ৭ টার দিকে দুই শতাধিক সন্ত্রাসী ও লাঠিয়াল বাহিনী দেশীয় অস্ত্র (দা, শাবল, লোহার রড, কাঁচি) নিয়ে গোটা মুন্ডাপাড়াসহ সকল পরিবারকে অবরুদ্ধ রাখে। এই সময়ে ভূমিদস্যুরা বড় পাওয়ার ট্রিলার দিয়ে ৮ বিঘা জমি অতিদ্রুত চাষ সম্পন্ন করে। জমিতে আমন চাষের জন্য ২০০ কেজি ধানের বীজতলা ছিল। সব ধ্বংস করা হয়।
ঘটনার সময় নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিলেন এবং তিন মুন্ডা নারী বিলাসী মুন্ডা, সুলতা মুন্ডা ও রীনা মুন্ডা প্রয়োজনীয় কাজের জন্য বাইরে ছিলেন। যখন মুন্ডাপাড়ার দিকে চাষের ট্রাক্টর আসে তখন মুন্ডা নারীরা জিজ্ঞেস করেন চালককে, কোথায় চাষ করবেন। তখন চালক বলেন, সামনে অন্যের জমিতে। এই কথা শুনে নারীরা আর কিছু বলেননি। কিন্তু হঠাৎ করেই তারা চাষের ট্রাক্টর তাদের বিবাদমান জমিতে নামিয়ে দেন এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই শতাধিক সন্ত্রাসী ও লাঠিয়াল বাহিনী তাদের পাড়াকে ঘিরে ফেলে এবং সবাইকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ফলে গ্রামের অন্য লোকজন বের হতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। অবশেষে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ আসে অনেক দেরিতে। তার আগেই ঘটনা ঘটিয়ে দুস্কৃতিকারীরা চলে যায়।
নাগরিক প্রতিনিধিদল জানতে পেরেছেন যে, মৃত মুল্লুক চাঁদ মুন্ডা জীবিত অবস্থায় ১৯৪৮ সালে ৮০০ (আটশত) টাকার বিনিময়ে মাদার গাইনের নিকট বন্ধকী রাখেন তার দখলীয় ৮ (আট) বিঘা জমি। অপরদিকে মাদার গাইন বন্ধকী দলিল দিয়ে নিজ নামীয় মালিক হন এবং পরবর্তীতে তিনি গফুর সরদারের নিকট বিক্রয় করেন। এভাবেই বন্ধকী দলিলকে পুঁজি করে বিবাদীগণ জমির মালিক হন, যা বেআইনী। প্রজাসত্ব আইন অনুযায়ী কোনো আদিবাসী বা এবরিজিনালের জমি, যেখানে মুন্ডা অন্তর্ভুক্ত জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া রেজিস্ট্রি হতে পারে না। উল্লেখ্য, এই জমির সমস্যা নিয়ে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিবাদীগণ জমির সঠিক কাগজপত্র দেখাতে পারিনি।
সুন্দরবন আদিবাসী মুন্ডা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, জমির কাগজপত্র ও দলিল সংগ্রহপূর্বক জানা যায়, মোট ৫৪ বিঘা জমি নিয়ে এই সমস্যা। নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা ও ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা গং ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ৮ নং ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এডভোকেট জি এম শোকর আলী ও ইউপি সদস্য গাজী গোলাম মোস্তফা’র নিকট লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয় যে, চেয়ারম্যান বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের কাগজপত্র পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত দেন যে, বিবাদী পক্ষ ক্রয়সূত্রে মালিক ১ নং দাগের জমিতে কিন্তু ১৪ নং দাগের জমি তারা ভোগ করতে পারবেন না। ১৪ নং দাগ ছেড়ে দিতে হবে এবং দলিল মোতাবেক ১ নং দাগে আপনাদের ভোগদখল করতে হবে। ২০১৭ সালের সিদ্ধান্ত মোতাবেক চেয়ারম্যান শোকর আলী ও ইউপি সদস্য গাজী গোলাম মোস্তফা নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা ও ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা গং কে ভোগ দখল করার অনুমতি দিলে তারা সেখান থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ভোগ দখলে ছিলেন। ২০২২ সালের জুন মাসের দিকে ইউপি চেয়ারম্যান শোকর আলী হঠাৎ করে নোটিশের মাধ্যমে উভয় পক্ষকে সকল প্রকার কাগজপত্রাদি ও স্বাক্ষীসহ হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট দিনে কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়। নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা ও ফনিন্দ্রনাথ মুন্ডা গং এর পক্ষে এডভোকেট চঞ্চল বাবু জবাব দেন এবং জবাবের বিপক্ষে বিবাদী পক্ষের কাগজপত্র যথাযথ না হওয়ায় চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যেহেতু মহামান্য আদালতে ২টি মামলা চলমান আছে সেহেতু তিনি এখন কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। মহামান্য আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। তবে উল্লেখ্য, বর্তমানে যে যেভাবে দখলে আছে সে সেইভাবে ভোগ দখল ভোগ করবে। তিনি আরো বলেন, রায়ের পূর্বে যেন কোনো প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করা না হয় অথবা সহিংস/অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। এমতাবস্থায় জুলাই মাসে ঐ ৮ বিঘা জমিতে রাশিদুল ও এবাদুল গং (মামলার প্রধান আসামী) চাষাবাদ করার জন্য ২ বার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে ভোগ দখলের জন্য হানা দেয় কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।
এই জমি নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে কোর্টে ডিগ্রীর মামলা চলমান রয়েছে। নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার ঘটনায় নতুন একটি মামলা রুজু হলো শ্যামনগর থানায়, যার নম্বর-৩৮/৩৫১ । এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত আসামীদের মধ্যে থেকে মাত্র ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে মুল বা প্রধান আসামী ৬ জনের মধ্যে একজনও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিনিধিদলের মনে হয়েছে যে, পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর নয়। স্থানীয় জনগণ বলেছেন, থানার পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। চারজন আসামী গ্রেপ্তারই যেন অনেক বড় অর্জন তাদের কাছে। অথচ এখনো মুল আসামীরা ধরা পরেনি। তাছাড়া ঘটনার সময়ও বিভিন্নভাবে স্থানীয় থানায় খবর দেয়া হলেও পুলিশ এসেছে অনেক দেরিতে।
সুন্দরবনের এই অঞ্চলে প্রাচীন আদিবাসী হলেন এই মুন্ডা জাতি। জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলায় ২০টি গ্রামে ৪২০টি মুন্ডা পরিবারের বাস যাদের জনসংখ্যা ১,৭৬৪ জন মাত্র। বৃটিশ শাসনের আগে থেকে এই অঞ্চলে মুন্ডাদের বসতি গড়ে ওঠে। গভীর সুন্দরবনের মধ্যে জনবসতি গড়ে তোলার জন্য মুন্ডাদের আগমন এই অঞ্চলে। এককালে তাদের মূল পেশা ছিল সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করা আর নদীতে কাঁকড়া ও মাছ ধরা। আজ তারা বড় অসহায় ও ভূমিহীন হয়ে পড়ছে নানা অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে। এখন মুন্ডারা এক অতি দরিদ্র ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে এই ধরনের অবিচার ও মানবাধিকার লংঘন তাদের ঠেলে দিচ্ছে সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, বিলুপ্তির দিকে।
সংবাদ সম্মেলনেবিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। এছাড়া জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মুন্ডা অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আশিক-ই-একাহি, মুন্ডা অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ঘোপাল চন্দ্র মুন্ডা, মামলার বাদী ফরিন্দ্র নাথ মুন্ডা, এবং ঘটনার ভিকটিম রিনা মুন্ডা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।