হিল ভয়েস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকা: বান্দরবানের লামায় রেংইয়েন পাড়ার একমাত্র পানির উৎসে বিষ প্রয়োগের ঘটনার প্রতিবাদে এবং স্থানীয় আদিবাসীদের ৪০০ একর ভূমি রক্ষার দাবিতে আজ ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ঢাকাস্থ আদিবাসী ছাত্র সংগঠনসমূহের আয়োজনে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।
উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চ্যং ইয়ুং ম্রো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষার্থী দনওয়াই ম্রো’র সঞ্চালনায় সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পিসিপি ঢাবি শাখার সদস্য শৈশানু মারমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই, লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র আহ্বায়ক রংধনু ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্সস কাউন্সিল (বিএমএসসি) এর ঢাকা মহানগরের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অংশুয়ে চিং মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি রেং ইয়ং ম্রো প্রমুখ।
সমাবেশে অনন্ত বিকাশ ধামাই বলেন, পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের জন্য ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকর না হওয়ায় লামার মত আদিবাসী উচ্ছেদের ঘটনা বার বার ঘটতে চলেছে। আমি অবিলম্বে পার্বত্য ভূমি কমিশন কার্যকর সহ সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের জোর দাবী জানাচ্ছি।
অলীক মৃ বলেন, লামায় আদিবাসীদের জুম ভূমিতে আগুন দিয়ে প্রথমে তাদেরকে ভাতে মারার চেষ্টা করলো। তারপর আবার পানির উৎসে বিষ দিয়ে পানিতেও মারার চেষ্টা করছে রাবার কোম্পানির লোকজন। এসব ঘটনার কোনোটিরই সুরাহা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা আশা করি না। কেননা বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি ঝেঁকে বসেছে তাতে আমরা কেউই নিরাপদ নয়।
তিনি আরো বলেন, আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে পাহাড় প্রকৃতি রক্ষা করে আসছে। আর সমতলের বাঙালীরা গিয়ে নষ্ট করছে। আমরা পবিরেশ রক্ষার কথা বলি। কিন্তু যারা এই পরিবেশ রক্ষা করছে তাদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবীও করেন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি রেং ইয়ং ম্রো। সংহতি বক্তব্যে তিনি বলেন, আদিবাসীদের ভূমি বেদখল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা এবং ভূমির উপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছিল। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে ভূমি কমিশন আইন বাস্তবায়ন ও কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনা করা ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে আমরা দেখছি। যার কারণে লামার সরই ইউনিয়ন বলেন কিংবা চিম্বুকে পাঁচতারা হোটেল স্থাপন বলেন সবক্ষেত্রেই ভূমি দস্যুরা তৎপর। আমরা একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটতে দেখছি সেখানে ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করারই প্রয়াস লক্ষ করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই এসব হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।
তিনি আরো বলেন, লামায় সরই ইউনিয়নের রেংইয়েন পাড়ার একমাত্র ঝিরিতে কোম্পানির লোকজনের বিষ প্রয়োগের যে ঘটনা সেটা একই সাথে বন্য ও জলজ প্রাণী নিধন এবং মানুষ হত্যা চেষ্টা বলে আমরা মনে করি। প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ এই অপরাধকে দ্বিগুণ প্ররোচিত করেছে। তাই অনতিবিলম্বে এসব ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের যথাযথ প্রয়োগসহ অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।
লামা সরই ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজান ত্রিপুরা বলেন, এই সমাবেশের উপস্থিতি দেখে বুঝতে পারছি যে, লামার আদিবাসীরা একা নয়। আমরা ৪০০ একর ভূমি ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। আমাদের এই আন্দোলনে দেশের সকল প্রগতিশীল মানুষকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
বিএমএসসি’র ঢাকা মহানরের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বুয়েটের শিক্ষার্থী অংশুয়ে চিং বলেন, ঝিরিতে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে গণহত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগেও জুম ভূমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পুলিশকে সব জানানোর পরও তারা অভিযোগ আমলে নেননি। বরং স্থানীয় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব জবার আমরা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করি।
সংহতি বক্তব্যে ঢাবি শিক্ষার্থী ও পিসিপি ঢাবি শাখার সদস্য শৈশানু মারমা বলেন, লামার আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা আজকের নয়। বহু আগে থেকে তারা আদিবাসীদের উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। কিন্তু ভুলে যাবেন না, পাহাড়ীরা তাদের অধিকারের জন্য সশস্ত্র লড়াই করেছিল। যদি এভাবে দিন দিন ভূমি কেড়ে নিয়ে আমাদেরকে ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয় তাহলে পাহাড়ের জুম্ম ছাত্র সমাজ বসে থাকবে না৷ তখন যেকোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির দায় সরকারকে নিতে হবে বলেও হুশিযারী দেন এই ছাত্রনেতা৷
এছাড়াও সমাবেশে সংহতি জানান বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার বাসিন্দাদের পানির প্রধান উৎস কালাইয়া ঝিরিতে রাবার কোম্পানীর ১৪/১৫ জন শ্রমিক দুই দলে ভাগ হয়ে মাছ শিকারের জন্য বিষ ছিটিয়ে দেয়। গ্রামবাসীদের এলাকা ছাড়া করে জায়গা দখল করার জন্য কোম্পানির লোকজন এ সুক্ষ্ম পরিকল্পনা করে যাচ্ছে এলাকাবাসীর মত। বিষ প্রয়োগের ফলে পানি দূষিত হয়ে গেছে। পানি তো পান করা যাচ্ছে না, ঝিরির মাছ, চিংড়ি ও কাকড়া মারা যাচ্ছে।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রকল্প পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জহিরুল ইসলাম গং ২০০ জনের অধিক মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ভাড়া করে ভূমিজ সন্তান লাংকম পাড়া, জয় চন্দ্র পাড়া ও রেংয়েন পাড়াবাসীদের ৪০০ একর প্রথাগত জমি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চালায় এবং আদিবাসীদের লাগানো ফলদ চারা যেমন আনারস, বরই, আম, জাম, কাঠাল গাছ ও বাঁশ বাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সাফ করে দেয়। এরপর ২৬ এপ্রিল ২০২২ তারা ওই জমির বাগানে আগুন দিয়ে প্রাকৃতির পরিবেশসহ লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করেছে।