হিল ভয়েস, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার জীবতলী ইউনিয়নে সম্প্রতি সিএনজি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে জীবতলী ইউনিয়ন ও মগবান ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান, হেডম্যান ও কার্বারিদের ডেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাপ্তাই সেনা জোনের পক্ষ থেকে হুমকি প্রদান ও গালিগালাজ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকালে কাপ্তাই সেনা জোনের টুআইসি মো: মোস্তাফিজ জোনে ডেকে এলাকার গণমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত এইসব আদিবাসী জুম্ম ইউপি চেয়ারম্যান, হেডম্যান ও কার্বারিদের সাথে দুর্ব্যবহার করে হুমকি প্রদান ও গালিগালাজ করেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে।
সেনা কর্মকর্তার এমন অবাঞ্ছিত ও অস্বাভাবিক ব্যবহারে উক্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিগণ এবং ঘটনাটি শুনে এলাকাবাসী অনেকেই অপমানিত বোধ করেন এবং গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার পার্শ্ববর্তী কাপ্তাই উপজেলার কাপ্তাই সেনা জোনের টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ জীবতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা, ১০৫নং জীবতলী মৌজার হেডম্যান হিটলার দেওয়ান, জীবতলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বরুণ চাকমা, মগবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পুষ্প রঞ্জন চাকমা, ১০৬নং কামিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান এ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, মগবান ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল তঞ্চঙ্গ্যা এবং উভয় মৌজার কার্বারিদের (গ্রাম প্রধান) কাপ্তাই সেনা জোনে উপস্থিত হতে খবর দেন।
টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ এর খবর মোতাবেক উক্ত ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার এবং মৌজার হেডম্যান ও কার্বারিগণ গতকাল ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকাল ৯:৩০ টায় কাপ্তাই সেনা জোনে উপস্থিত হন। এসময় চেয়ারম্যান, মেম্বার, হেডম্যান ও কার্বারিদের সভাস্থলে প্রথমে জোন কম্যান্ডার লে: কর্ণেল মোঃ ফেরদৌসকে আসতে দেখা গেলেও তিনি শেষ পর্যন্ত আসেননি এবং টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজই সেখানে উপস্থিত হন।
জানা গেছে, টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ সভাস্থলে আসার সাথে সাথে এবং উপস্থিত জুম্ম নেতৃবৃন্দ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ উপস্থিত জুম্ম নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, ‘আপনারা সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করেন। আপনারা জানেন, ১৬ সেপ্টেম্বর জেএসএস সন্ত্রাসীরা সিএনজি পুড়িয়ে দিয়েছে।” কেন আপনারা জোনে জানাননি বলে প্রশ্ন করে, টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ জুম্ম নেতৃবৃন্দকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন বলে জানা যায়। এছাড়া, টুআইসি মোঃ মোস্তাফিজ যদি আরও এই রকম ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে আপনারা কেউই রেহাই পাবেন না বলে হুমকি প্রদান করেন বলে জানা গেছে।
এছাড়াও, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকাল ১০:০০ টায় রাঙ্গামাটি ডিসি কার্যালয়েও একই বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, হেডম্যান ও কার্বারিদের নিয়ে এক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। সেখানেও উক্ত নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হন। সভায় সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি/সম্পাদক, রাঙ্গামাটি উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা চেয়ারম্যান, পুলিশ সুপার, গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
উক্ত আলোচনা সভাও শুরু হওয়ার সাথে সাথে জনৈক সেনা কর্মকর্তা জুম্ম নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে একতরফাভাবে বলেন যে, ‘জেএসএস সন্ত্রাসীরা সিএনজি পুড়িয়ে দিয়ে কী লাভ হলো তাদের? আপনারা সন্ত্রাসীদের লালনপালন করছেন, চাঁদা দেন, বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছেন।’ উক্ত সেনা কর্মকর্তা হুমকি দিয়ে আরো বলেন যে, ‘এরকম যদি আরো একবার হয়ে থাকে আমরা সেনাবাহিনীরা সাধারণ জনগণের উপর অত্যাচার করতে বাধ্য হবো।’
উল্লেখ্য, গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ জীবতলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ২ নম্বর আগর বাগান নামক স্থানে কে বা কারা একটি সিএনজি চালিত ট্যাক্সি পুড়িয়ে দেয়।
উক্ত ঘটনাকে অজুহাত করেই সেনাবাহিনী নির্বিচারে উক্ত এলাকার জুম্ম ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার, হেডম্যান ও কার্বারিদের ডেকে হয়রানি, দুর্ব্যবহার ও গালাগালি করছেন, হুমকি দিচ্ছেন, মিথ্যা অভিযোগ করছেন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জেএসএসকে উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত করছেন।
রাঙ্গামাটি শহরের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অধিকার কর্মী জানান, এটা তো সবাই জানে যে, যেখানে সিএনজি চালিত ট্যাক্সিটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার কাছাকাছি এলাকায় কারা থাকে? সেনাবাহিনী ও সেনামদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের দমনপীড়নের কারণে সেখানে জেএসএসের কোনো কার্যক্রমই বর্তমানে নেই।
তারা বলেন, ঐ ঘটনাস্থলের কিছু দূরেই তো জীবতলী চেয়ারম্যান পাড়ায় সেনা মদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা ঘাঁটি স্থাপন করে থাকে। সেখান থেকে ওই সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর ইশারায় ও মদদে জীবতলী ও মগবান ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, জনগণকে মারধরসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি অভিযোগ পাওয়া যায় যে, গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ হতে জীবতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাড়ায় অবস্থানকারী ইউপিএিফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা বরুণ কার্বারির নেতৃত্বে তাদের জনবল বৃদ্ধি করে ৪০/৪৫ জন সদস্য নিয়ে অবস্থান করছে। এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকাল আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে জীবতলী সেনা ক্যাম্পের একটি সেনাদল চেয়ারম্যান পাড়ায় সন্ত্রাসীদের আস্তানায় আসে। এরপর সকাল আনুমানিক ১০:০০ টার দিকে সেনাদলটি এসকর্ট দিয়ে সন্ত্রাসী দলের সকল সদস্যদের জীবতলী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এরপর জীবতলী সেনা ক্যাম্পে সেনাবাহিনী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের মধ্যে প্রায় দিনব্যাপী এক গোপন বৈঠক হয় বলে জানা যায়। এরপর বিকাল ৫:০০ টার দিকে সেনাদলটি আবার এসকর্ট দিয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীদের তাদের আস্তানায় পৌঁছে দেয় বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, প্রায় তিন বছর পূর্বে সেনাবাহিনীই এসকর্ট দিয়ে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীদের একটি সশস্ত্র দল জীবতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পাড়ায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে রাঙ্গামাটি সদরের বিভিন্ন এলাকায় এসব সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ব্যক্তি খুন, মারধার, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
একাধিক অভিযোগ রয়েছে যে, সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট এইসব সন্ত্রাসীদের দল মিলে যৌথভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাঝে মাঝে টহল অভিযান ও গ্রামে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করে থাকে।