হিল ভয়েস, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: টাঙ্গাইল জেলার মধপুরে সরকারের বনবিভাগ কর্তৃক পর্যটন ও উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের কৃষিজমিতে হ্রদ বা পুকুর খনন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুরু থেকে নিজেদের সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা করে স্থানীয় আদিবাসীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও বনবিভাগ তার পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
গতকাল ৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ মধুপুরের আমলীতলা খেলার মাঠে ‘সম্মিলিত আদিবাসী জনতা’র ব্যানারে আদিবাসীরা ‘উঠে দাঁড়া ভাই-বোনেরা, শাল গজারি বন/আমার ঘরে দিচ্ছে হানা, মিথ্যে উন্নয়ন’ শ্লোগান নিয়ে বনবিভাগের উক্ত হ্রদ বা পুকুর খননের প্রতিবাদে এক প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শালবনের চিৎকার’।
হাজারো মানুষের সমাগমে উক্ত ‘শালবনের চিৎকার’ অনুষ্ঠানের সাথে প্রতিবাদী গানে গানে সংহতি জানিয়েছেন শিল্পী কফিল আহমেদ, গানের দল মাদল, সমগীত, আচিক ব্লুজ, রংখেক রংসা, সবুজ মাঝি প্রভৃতি।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য টনি চিরান বলেন, ‘শালবনের চিৎকার’ শুধু গান আয়োজনই নয় বরং আদিবাসীদের জীবন ও প্রাণ-প্রকৃতির পক্ষে চিরকাল লড়াইয়ের সঙ্গী হয়ে উঠার প্রত্যয়। এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েই আমরা শালবনের চিৎকার আয়োজন করেছি। এই চিৎকার মধুপুরের শালবনে আদিবাসীদের চিৎকার, এই চিৎকার প্রাণ-প্রকৃতির চিৎকার। শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে নিজ ভূমিতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে লেক খনন করতে দিবো না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য অলিক মৃ বলেন, ‘শালবনের চিৎকার’ মধুপুরের আদিবাসীদের জমে থাকা অগ্নিশিখার বহিঃপ্রকাশ। বনবিভাগ কর্তৃক আদিবাসীদের কৃষি জমিতে চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে লেক (হ্রদ) খনন প্রকল্প আদিবাসীরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিথ্যে উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই-সংগ্রাম জারি রাখবে। এ সংগ্রামেরই অংশ শালবনের চিৎকার।
প্রতিবাদী এ ‘শালবনের চিৎকার’ আয়োজনের আহ্বায়ক ছাত্রনেতা জন জেত্রা’র সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব লিয়াং রিছিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা প্রমুখ।
ঝড়ো বৃষ্টি উপেক্ষা করেও গানের দল মাদলের গানের তালে তালে হাজারো মানুষের সুরে ধ্বনিত হয়েছে- ‘শালবৃক্ষের মত সিনা টান করে সে, মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন জান দিয়েছে’। মাদলের এই প্রতিবাদী গানের মধ্য দিয়েই শালবনের চিৎকার এর প্রতিবাদী গান সমাপ্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইকোপার্ক, ইকোট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ, সংরক্ষিত বনাঞ্চল কিংবা চিত্তোবিনোদনের উদ্দেশ্যে লেইক খনন সহ তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে রাষ্ট্র। বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রের এইসব উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে- টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত চুনিয়া, সাইনামারী, থানারবাইদ, পীরগাছা, ভুটিয়া ও পেগামারী গ্রামের পার্শ্বে ১১নং শোলাকুড়ী ইউনিয়নের পীরগাছা মৌজার আমলীতলা নামক বাইদে/নিচু জমিতে কৃত্রিম লেইক খনন ও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের শুধুমাত্র মনোরঞ্জন বা চিত্তবিনোদনের জন্য আদিবাসীদের ৩ ফসলির মোট ৪৫ বিঘা কৃষি জমি কেড়ে নিয়ে বন বিভাগের আধুনিক পর্যটন প্রকল্প। যা নিরীহ আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উপর মারাত্মক হুমকি। প্রাকৃতিক বন উজাড় করে বন বিভাগ বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ‘সাসটেইনেবল ফরেস্ট এন্ড লাইভলিহুড বা সুফল’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আদিবাসী স্বার্থবিরোধী বনবিভাগের লেক খনন পরিকল্পনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ‘সন্মিলিত আদিবাসী ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে আদিবাসীরা শুরু থেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছে।