হিল ভয়েস, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, চট্টগ্রাম: পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখার উদ্যোগে চবি ক্যাম্পাসে আয়োজিত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নবীন বরণ ও বিদায় সংবর্ধনা ২০২২ অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, ভূমি হারাতে হচ্ছে, প্রশাসনের সহযোগিতায় রাবার কোম্পানি কর্তৃক ম্রোদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রথাগত অধিকার অনুযায়ী আমাদের ভূমি অধিকার ফিরে পাচ্ছি না। ঝিরির পানিতে বিষ দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গতকাল ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ চবি’র আইন অনুষদের এ কে খান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত নবীন বরণ ও বিদায় সংবর্ধনা-২০২২ অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঊষাতন তালুকদার এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি থোয়াইক্যজাই চাক প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগ্রামী সভাপতি নবোদয় চাকমা।
‘শেকড়ের টানে এসো মেলাই প্রাণে প্রাণ, অস্তিত্ব রক্ষায় নবীন হও বলীয়ান’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত উক্ত অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নবীন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বরণ ও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সকালের পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়া নবীন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পরিচয় ও অনুভূতি প্রকাশ এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পরিচিতি ও স্মৃতিচারণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বে সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্থী রেমা ও মুক্ত দিবরা।
অনুষ্ঠানের মূল আলোচনা সভায় নরেশ চাকমার সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সত্যপ্রিয় চাকমা। নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন উসাহ্লা মারমা এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সুদীপ্ত চাকমা। এছাড়াও নবীনদের উদ্দেশ্যে বরণমাল্য পাঠ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাছেনহ্লা এবং প্রবীণদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন মিলিপ্রু মারমা।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ঊষাতন তালুকদার আরও বলেন, সরকার পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ঠিকই, তার আংশিক বাস্তবায়নও করেছে, কিন্তু সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো শান্তি ফিরে আসেনি। তিনি বলেন, আমরা দেশের ক্ষতিকর বস্তু নয়, আমরা দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকারের সঙ্গে বেঁচে থাকতে চাই। আজকের খেলাধুলাসহ নানা অবদানের মাধ্যমে আদিবাসীরা দেশের সুনাম বয়ে নিয়ে আসছে।
ঊষাতন তালুকদার বলেন, চট্টগ্রাম আমাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সুসম্পর্ক আছে। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে অধিক সংখ্যক আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণের নিমিত্তে পিসিপি’র জন্ম। শিক্ষার পাশাপাশি জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় ছাত্রসমাজের যে দায়বদ্ধতা সেই জায়গা থেকে এই সংগঠন দীর্ঘকাল ধরে ভূমিকা রেখে আসছে।
ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মানবিক শিক্ষা চর্চার কেন্দ্রস্থল। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আপনাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো মূল্যবোধসম্মন্ন জ্ঞান অর্জন করা। এই মূল্যবোধ অর্জন করার মাধ্যমে আপনাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আপনার জীবন, অধিকার, অর্থনীতি, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি রাজনীতির উপর নির্ভরশীল। তার জন্য একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানা জরুরি।
নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সময়টা অহেতুক ব্যয় না করে, যথাযথ ব্যবহার করুন। এম এন লারমা যেমন অন্ধকার থেকে আলো ছড়িয়েছেন পাহাড়ে, আপনারাও সেভাবে দেশ-সমাজের জন্য সুনাম বয়ে নিয়ে আসবেন। আমাদের অস্তিত্ব আজ সংকটময় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসাটা সময়ের দাবি।
বিশেষ অতিথি ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে নবীনদের উদ্দেশ্যে বলেন, অনেক দীর্ঘ এক পথ পরিক্রমার পরে নবাগত ছাত্রদের শুভেচ্ছা ও স্বাগতম। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের নিজেকে গড়ে তুলে সমাজ, দেশ, জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন আসলে কী জিনিস তা তোমাদেরকে প্রথমে উপলব্ধি করে পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নিজেদের তৈরি করতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কী করবো সেটা ঠিক করা উচিত। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাদের ষাট শতাংশের অধিক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সময় নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। এইসব বাধা পেরিয়ে জীবনকে জয় করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের শেকড়ের সন্ধান করতে হবে। আমাদের দেশ, সমাজ, জাতির কল্যাণে এগিয়ে আসতে হবে।
সহকারী প্রক্টর অরূপ বড়ুয়া বলেন, নবীন শিক্ষার্থী যারা ভর্তি হয়েছো তারা অনেক মেধার পরিচয় দিয়ে নিজের স্থান করতে পেরেছো। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট নিরসনের জন্যে এই চলতি বছরের মধ্যেই দুইটা নতুন হল খুলে দেওয়া হবে। এভাবে আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের আবাসন সমস্যা আশা করি সমাধান হবে।
তিনি আরো বলেন, কোটা একটা অধিকারের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তাদের নিয়ম অনুযায়ী কোটা আসনে ভর্তির সুযোগের জন্যে সচেতন হতে হবে। যদি কোটার আসন সঠিকভাবে প্রয়োগ না হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে প্রশাসন বরাবর আবেদন করলে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে।
বিশেষ অতিথি ছাত্রনেতা থোয়াক্যজাই চাক বলেন, নবীনদের এই বিশ্ববিদ্যালয় নামক বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিশ্বমানের জ্ঞান আহরণের জন্য মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং সমাজের কল্যাণের স্বপ্ন দেখতে হবে। একজন ছাত্র হিসেবে নিজের জাতির অবস্থা কোন পর্যায়ে, আর নিজে কোন পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন, এসব বিষয়গুলো গভীরভাবে হৃদয়ে উপলদ্ধি করে নিজের শেকড়ের টানে নিজের সমাজের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আমরা পড়াশোনার মাধ্যমে শিক্ষিত হবো, একই সঙ্গে অধিকার নিয়েও সচেতন ও শিক্ষিত হতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আজকের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের অকার্যকর অবস্থা সরকারের ব্যর্থতার ও আন্তরিকতাহীনতার ফল। আজকের সময়ে আমাদের ভূমি সুরক্ষিত নেই, আইনগত অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে দিন দিন, উৎপাদন ব্যবস্থাতে নেই আমাদের নেতৃত্ব। আজকের আদিবাসী সমাজে নারীদের মুক্তি কিংবা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্চশিক্ষিত নারীদের এগিয়ে আসা জরুরী। দীর্ঘ পথযাত্রার মধ্যে দেশ, জাতি ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে সত্যপ্রিয় চাকমা বলেন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ প্রতি বছর ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কার্যক্রম করে থাকে। তার মধ্যে এই নবীন বরণ প্রোগ্রাম অন্যতম। এইসব প্রোগ্রামের মাধ্যমে অধ্যয়নত পাহাড় ও সমতল থেকে আসা চবিতে অধ্যয়নরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুসম্পর্ক রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া তিনি কোটার আসন বৃদ্ধিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটে উদ্যোগ নেয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সভাপতি নবোদয় চাকমা তার বক্তব্যে বলেন, প্রায় সাতশ’র অধিক আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসে আমরা প্রত্যেকে ভিন্ন মতাদর্শ, চিন্তা-ভাবনা লালন করতে পারি। তবে জাতির সংকটময় পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের নিজের শেকড়ের কথা ভুলে গেলে চলবে না, নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ভাল কাজের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে।
আলোচনা সভা শেষে, রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীবৃন্দের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবীন বরণ ও প্রবীণ বিদায় অনুষ্ঠান-২০২২ এর সমাপ্তি ঘটে।