হিল ভয়েস, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ঢাকা: মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৮৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
আজ (১৫ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬.০০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহীদ বেদীতে এই আয়োজন করা হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমেধ চাকমা’র সঞ্চালনায় এবং সংগঠনটির সভাপতি সতেজ চাকমা’র সভাপতিত্বে প্রথমে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয় এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
উক্ত স্মরণ আয়োজনে বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সৈসানু মারমা, সংগঠনটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা। এছাড়াও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ এর সভাপতি ঐতিহ্য চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের সিনিয়র সদস্য ও পিসিপি’র সাবেক ছাত্রনেতা লিটন চাকমা, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্তিময় চাকমা প্রমুখ।
পিসিপি’র ঢাবি শাখার সদস্য সৈসানু মারমা বলেন, শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একটি সূর্যের মত। তিনি জুম্ম জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় জুম্মদের অন্ধকার দূর করার জন্য সূর্যের মত দেদীপ্যমান হয়ে শিক্ষা ও চেতনার আলো ছড়িয়েছেন। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে তাঁর রুখে দাঁড়ানো শুরু হয় এবং সেখান থেকেই তিনি জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করেছেন। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরী।
ঢাবি’র শিক্ষার্থী শান্তিময় চাকমা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছড়িয়ে দেয়া জুম্ম জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদ আমাদের জুম্ম তরুণ সমাজের প্রত্যেকটি তরুণ ধারণ করুক এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি জুম্ম পরিবারের মাঝে সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে এ ধরনের আয়োজন করতে হবে। ঘুণে ধরা সামন্তীয় সমাজকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেভাবে বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন তা আজও জুম্ম তরুণ সমাজকে আলোড়িত করে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র প্রতিবাদী চরিত্র আমাদের সবাইকে ধারণ করতে হবে এবং তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নে আমাদের সবার করণীয় নির্ধারণ করা উচিত।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরে ছাত্রনেতা অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা এই মহান নেতার কাছ থেকে শিক্ষা পাই মহান বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার। শিক্ষা পাই উদারতার, শিক্ষা পাই ত্যাগের, শিক্ষা পাই শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার। প্রতিটি জুম্ম ছাত্রের উচিত তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া।
সিনিয়র শিক্ষার্থী ও পিসিপি’র ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক লিটন চাকমা বলেন, বর্তমানে দেখা যায় আমাদের জুম্ম তরুণের একটি বিশাল অংশ শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন ও সংগ্রামকে জানে না। তাঁকে জানার জন্য, তাঁর চেতনাকে ধারণ করার জন্য ও তার প্রতিষ্ঠিত আত্মনিয়ন্ত্রাধিকারের সংগ্রামকে বুঝার জন্য আমাদের সবার তাঁর জীবন ও সংগ্রাম বইটি অধ্যয়ন করতে হবে। বর্তমানে জুম্ম জাতীয়বাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় তরুণ ছাত্র সমাজকে এগিয়ে এসে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
স্মরণ আয়োজনে ঢাবি জুম সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি ঐতিহ্য চাকমা সংহতি জানিয়ে বলেন, কাপ্তাই বাঁধের সময় আমরা জানি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর ঘরের উঠান থেকে এক মুঠো মাটি তুলে তাঁর বড়বোনকে দিয়েছিলেন এবং সযত্নে রাখতে বলেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় তিনি মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে কতটা ভালোবাসতেন। তিনি একাধারে বিপ্লবী যেমন ছিলেন, তেমনি একজন শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার মননশীল মানুষও ছিলেন বলে আমরা জানি। তিনি সুর করে বাঁশি বাজাতেন বলে আমরা জানি। তাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতেই হবে।
উক্ত স্মরণ অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সতেজ চাকমা। তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমরা যদি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র জীবনকে পর্যালোচনা করি তাহলে আগাগোড়া একটা বিপ্লবী ও প্রতিবাদী চরিত্রে আমরা তাঁকে দেখতে পাই। সেই রাঙ্গামাটি সরকারি হাই স্কুলের হোস্টেলে সময়মত খাবার দেওয়ার জন্য হোস্টেল সুপারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আদিবাসীদের বাঙালিকরণের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র চিন্তাকে যদি বিবেচনা করি তাহলে বলতে হয়, তিনি তাঁর সময়ের চাইতেও প্রাগ্রসর ছিলেন। সংসদে তিনি বাঙালিকরণের বিরুদ্ধে যেমন কথা বলেছেন, ওয়াকআউট করেছেন। তেমনি মেথর, যৌনপল্লির পতিতা, বেদে, গরীব কৃষক ও মেহনতী মানুষের অধিকারের জন্যও তিনি কথা বলেছেন। এমনকি ভবঘুরেদের জীবন বদলে দেওয়ার কথাও তিনি সেসময় সংসদে বলেছিলেন। তাই তাঁর জীবনকে আমাদের মত তরুণদের পাঠ করতেই হবে। শোষণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম যতদিন চলমান থাকবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ততদিন দেদীপ্যমান হয়ে আলো ছড়াবেন বলেও মনে করেন এই ছাত্রনেতা।