হিল ভয়েস, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে গোপনে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছে বলে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এ ধরনের সর্বশেষ বৈঠক হয় গত আগষ্ট মাসের শেষান্তে খাগড়াছড়ি সেনা ব্রিগেডে।
তবে কেন এই গোপন বৈঠক তা পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। এইসব বৈঠকের বিস্তারিত বিষয়বস্তু জানা না গেলেও তাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিরোধী ষড়যন্ত্রমূক কর্মকান্ডে কিভাবে ইউপিডিএফ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় ঘটনো যায়, সম্প্রতি ইউপিডিএফ কর্তৃক চুক্তি আকারে পেশকৃত দাবিনামা, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সূত্রগুলো জানায়।
একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ আগস্ট ২০২২ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টা হতে ৭টা’র দিকে খাগড়াছড়ি সেনা ব্রিগেডে ইউপিডিএফ এর খাগড়াছড়ি জেলা সংগঠক ও মুখপাত্র অংগ্য মারমার নেতৃত্বে একটি দল খাগড়াছড়ি ব্রিগেডের জিইটু ও খাগড়াছড়ি সদর সেনা জোনের জোন কম্যান্ডারের সাথে একটা গোপন বৈঠকে মিলিত হয়।
এছাড়া গত বছরের প্রথম দিকে খাগড়াছড়ি সদরে এবং খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া এলাকায় সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষে ইউপিডিএফ সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’এর সাথে একাধিক গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
গত ২৭ এপ্রিল ২০২১ উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা ও সচিব চাকমা’র নেতৃত্বে ইউপিডিএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর সাথে একটি গোপন বৈঠক করে। ঐ বৈঠকের একদিন পরেই ২৮ এপ্রিল ২০২১ ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় তাদের কার্যালয় উদ্বোধন করে এবং প্রকাশ্যে কার্যক্রম শুরু করে, যা সেনাবাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ’এর আপোষ সমঝোতা নির্দেশ করে।
এর পূর্বে ১৭ এপ্রিল ২০২১ দুপুরে পানছড়ি উপজেলার ছনখোলা পাড়ায় বিজিবি’র একটি টহলরত দলের সাথে অর্জুন চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ-এর একটি সশস্ত্র দলের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাতের পর তারা স্ব স্ব গন্তব্যের দিকে চলে যায়।
উল্লেখ্য, গত ৯ জুন ২০২২ পানছড়ির লামাক পাড়া গ্রামের সুনন্দ বিহারে ইউপিডিএফ বাংলাদেশ সরকারের নিকট তাদের দাবিনামা পেশ করার জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে ইউপিডিএফ’এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নতুন কুমার চাকমা ও উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমাসহ একদল প্রতিনিধি সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলামের নিকট চুক্তি আকারে পেশকৃত দাবিনামা পেশ করেন। যে দাবিনামায় চুক্তির বিভিন্ন ধারা সংশোধনসহ চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন দাবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত দাবিনামা পেশ করার পর পরই ১১ জুন ২০২২ ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্যরা পার্বত্য চুক্তি পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এটা সহজেই বলা যায় যে, জনমতের চাপের মুখে এতদিন পার্বত্য চুক্তি পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের উপর সশস্ত্র হামলা বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেও সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা হওয়ায় ইউপিডিএফ আবার নতুন করে এই সংঘাত ও হানাহানি শুরু করেছে। পক্ষান্তরে এই সংঘাতের দায় চুক্তি পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের উপর চাপিয়ে দিয়ে মিছিল-মিটিং আয়োজন করতে সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে বাধ্য করে চলেছে।
খাগড়াছড়ির লোকমুখে প্রচার হতে থাকে যে, প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ নেতারা মামলায় ফেরারী জীবন থেকে মুক্তি ও নিজেদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি করে গোপনে অস্ত্র সমর্পন করবে। এনিয়ে জুম্ম জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়। এসময় অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়- ইউপিডিএফের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন কোথায় গেল? কেন তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত ও বিরোধীতা করলো? কেন ২৪ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টি করে এসেছে? কেনইবা ইউপিডিএফ প্রত্যাগত জনসংহতি সমিতির বিপ্লবী সদস্যদের হত্যা করেছে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অধিকারকর্মীর মতে, ইউপিডিএফ-এর ৯ জুনের দাবিনামা পেশ আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং এটি ইউপিডিএফ (প্রসিত) ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিনের গোপন সংলাপ ও সমঝোতা প্রক্রিয়ারই ফল। তারা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করে না এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের দাবিনামা পেশ হাস্যকর।
তাদের মতে, এটা পরিষ্কার যে, ইউপিডিএফ আশ্রয়ের বিনিময়ে সেনাবাহিনীর সাথে আপোষ করতে চলেছে এবং দাবিনামা পেশ একটি নাটক মাত্র। এটা হচ্ছে, উভয় পক্ষ কর্তৃক সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল।
জনৈক এক পর্যবেক্ষকের মতে, গত জুন মাসে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ এর ব্যানারে ইউপিডিএফ কর্তৃক রাঙ্গামাটিতে আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ের সামনে সন্তু লারমাকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালিগালাজ করে মানববন্ধন এবং সাম্প্রতিককালে সশস্ত্র দল পরিচালনা করেও প্রকাশ্যে একের পর এক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পেছনেও ইউপিডিএফ ও সেনাবাহিনীর মধ্যেকার গোপন সম্পর্কের কারণে সম্ভব হচ্ছে।
সূত্রগুলোর মতে, বেশ কয়েক মাস আগে থেকে অত্যন্ত গোপনে ও সুকৌশলে সেনাবাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ এর এই যোগাযোগ ও সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কিছু বিশেষ কর্মকর্তা এবং ইউপিডিএফ এর পক্ষ থেকে উচ্চ বা মধ্য পর্যায়ের কিছু নেতা এর দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানা যায়।
সম্প্রতি বান্দরবানের একাধিক সূত্র জানায়, সেখানে সেনাবাহিনী তাদের মদদপুষ্ট ও লালিত-পালিত মগ পার্টি, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থী দলের নেতাকর্মীদের নিকট গোপনে এক মতামত জরিপ চালায়। এতে সেনাবাহিনী এসব দলের নেতাকর্মীদের কাছে জানতে চায় যে, যদি ইউপিডিএফ (প্রসিত) বান্দরবানে তার কার্যক্রম চালায় এতে এসব দলসমূহ ইউপিডিএফ (প্রসিত) দলের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে রাজী কিনা।
সূত্রটির মতে, সেনাবাহিনী মগ পার্টি, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), সংস্কারপন্থী ও বম পার্টি প্রভৃতি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে ইউপিডিএফকেও (প্রসিত) কিছু ছাড় ও সুবিধা দিয়ে হলেও নিজের করায়ত্তে ও ক্রীড়নকে পরিণত করতে চায়। তবে উক্ত দলের অনেকেই ইউপিডিএফকে (প্রসিত) সন্দেহের চোখে দেখে এবং তাদের সাথে কাজ করতে রাজি নয়। এতে এসব সশস্ত্র গ্রুপের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে বলে তারা মনে করেন।