মিতুল চাকমা বিশাল
ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাদেরকে সমাজে মহাপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁরা তাঁদের চিন্তা, দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমাজের ভেতর থেকেই আরেক নয়া সমাজের উদ্ভব ঘটান। যে সমাজ হয় প্রগতিশীল, উন্নত। সমাজ বিকাশের মূলে অর্থনীতির হাত থাকলেও কতিপয় এই মানুষগুলোই সেই অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং তার দ্বারা নির্ধারিত মানুষগুলোর চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করতে প্রয়াস করেন এবং সমাজকে বিকশিত করতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যান। সমাজের মানুষগুলোকে তারা দেখিয়ে যান, কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় এবং কেন বেঁচে থাকার জন্য লড়াইটা করতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বসু ও স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুদের মতন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই আলোকিত মানুষটি হচ্ছেন মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁর জীবনদর্শন ছিল কেবল নিপীড়িতের তরে, মানবতার কল্যাণে, শাসকের বিরুদ্ধে, অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর আদর্শকে প্রতিস্থাপন করে গেছেন লক্ষ-লক্ষ জুম্ম জনগণের কাছে। প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, লড়াইটা কেন লড়তে হবে! কার বিরুদ্ধে এই লড়াই! কারা লড়বে এই লড়াই! এই লড়াইয়ের সাথে জুম্ম জনগণের সম্পর্ক কী! তাই তো তিনি রেখে গেছেন অজস্র অনুরাগী, ভক্ত, শুভাকাক্সক্ষী ও এক সুদক্ষ জুম্ম সেনা। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে বিশ্বাসী প্রতিটি জুম্মই সেই সেনার এক একটি ঢাল এবং মোক্ষম হাতিয়ার।
ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে জন্ম নেয় কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তবে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত এবং পাকিস্তান। ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস নিয়ে পৃথক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলেও পরে নিজেদের সংবিধান রচনা করে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। ধর্মীয় দিকটি বিবেচনায় নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিভাজন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও সেই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হার ছিল ১.৫% এর কিছু অধিক। তারপরেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির বদলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পৃথক হওয়া পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে পাহাড়ের ইতিহাস এক ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়া শুরু করে। দেশবিভাগের পূর্বে এতদঞ্চলের জনগণ প্রকৃতির সাথে লড়াই করেছে,সুউচ্চ পর্বত আর ঘন বন্য পরিবেশের সাথে লড়াই করে বাসযোগ্য এক ভূমিতে পরিণত করেছে। এমনকি যারা সমগ্র বিশ্বকে চষে বেরিয়েছে, সেই ব্রিটিশদের সাথে লড়াইয়েও এতদঞ্চলের জনগণ বীরত্ব দেখিয়েছে এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্যতাকে টিকিয়ে রেখেছিল। উৎপাদন ব্যবস্থা সরল হওয়া সত্ত্বেও এতদঞ্চলের একটা শ্রেণির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ছিল, সেটা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। আর সেই রাজনৈতিক চেতনা ছিল বলেই পরপর ২টি মহাযুদ্ধ এবং নানা সংকটেও নিজেদের স্বকীয়তাকে অক্ষুণ্ন রেখে সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রেখেছিল। সেই রাজনৈতিক চেতনা ছিল বলেই দেশবিভাগের সময়েও এই অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের ভূমিকে স্বাধীন ভূমি হিসেবে পেতে চেয়েছিল এবং কেউ বা ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিল। কেউ বা সাংবিধানিক এক রাজতন্ত্রের প্রস্তাবও দিয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন রাজ্যগুলির সাথে সম্পর্কযুক্ত, সেটি সাংস্কৃতিকভাবে,জাতিগতভাবে এবং ভূ-প্রকৃতিগত দিক দিয়ে, এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়েও। অতএব স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের মানুষগুলোর মনে ভারতীয় ঝোঁক একটু স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পরপরই সেই ঝোঁকটিকে ধ্বংস করে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একাত্মীকরণের বদলে জবরদস্তিমূলক ও বলপ্রয়োগের নীতিকে সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পাহাড়িদেরকে পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের শত্রু ও হুমকিমূলক বলে গণ্য করে তাদেরকে উচ্ছেদকরণের নীতি প্রয়োগ করা শুরু করে। তারই লক্ষ্য হিসেবে ষাটের দশকে উন্নয়নের প্রলেপ দিয়ে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়া হয় এবং প্রায় ৫৪ হাজার একর ভূমিকে পানির নিচে তলিয়ে দিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে শরণার্থী জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন সামন্তীয় রাজন্যবর্গ এবং সমাজের কতিপয় রাজনৈতিক চিন্তা করা লোকেরা এই বাঁধের ক্ষতিকর দিকটি সম্পর্কে যথাযথ ওয়াকিবহাল না থাকলেও নতুন সমাজব্যবস্থার চেতনায় বেড়ে ওঠা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তিনি তাই প্রতিবাদের সুরও তুলেছিলেন,বিনিময়ে কারাবরণও করেছিলেন। কিন্তু তার লড়াইকে তিনি দমে যেতে দেননি। শূণ্য থেকে শুরু করে সহস্রতে, সহস্রথেকে লক্ষতে পৌঁছে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের কাছে হয়ে উঠেছিলেন মহান নেতা।
সেই থেকেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার হাত ধরে। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সুন্দর পার্বত্য চট্টগ্রামের, যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এক উন্নত ও প্রগতিশীল পার্বত্য চট্টগ্রামের। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার গন্ডি পেরিয়ে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃপ্ত শপথ নিয়ে এগিয়েছিলেন তিনি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জাতির মুক্তির জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং সেই লক্ষ্যে শহরের বিলাসিতা আর রঙিন জীবনকে ছেড়ে পাড়ি জমান জুম পাহাড়ে আলো ছড়িয়ে দিতে। তাঁর প্রদর্শিত আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে তাই ‘টিচার্স রেভুল্যূশন’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর চিন্তা,তাঁর সমগ্রতায় ব্যক্তিস্বার্থের কোন ঠাঁই হয় নি, তাঁর চিন্তা ছিল ব্যাপকতায়, সমগ্রতায়,জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ে এবং সর্বোপরি এই মানবজাতির মুক্তির কল্যাণে।
মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই অমোঘ বাণী ‘যারা মরতে জানে পৃথিবীতে তারা অজেয়, যে জাতি বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে পারে না, পৃথিবীতে তাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।’ তাইতো তিনি আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন, বেঁচে থাকার জন্যে। আজও তাঁর চেতনার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি লড়াইয়ের ময়দান ছেঁড়ে যায় নি। লড়াইয়ের শুরুটা তিনি করে দিয়েছেন, সেই লড়াইকে চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা নিঃসন্দেহে তরুণ প্রজন্মকেই নিতে হবে। পাহাড়ের বর্তমান বাস্তবতার কঠিন এই মুহূর্তগুলোকে সাহসিকতার সাথে প্রতিরোধ করতে এম এন লারমার সৈনিক হওয়া জরুরী। একমাত্র তাঁর প্রদর্শিত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতেই আমরা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে নূতনভাবে গড়ে তুলতে পারবো।
আমরা যুবক, যৌবন আমাদের ফুটন্ত, রক্ত আমাদের টগবগ করে ফুটছে, ইচ্ছা সীমাহীন, শত বাধা পেরোবার কঠিন পথটিও সহজ আমাদের কাছে। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে’। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, বড়গাঙ-চেঙে-শঙ্খ নদীর জল গড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের কর্মেন্দ্রীয় এবং বাহ্যেন্দ্রীয়কে সজাগ করার সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যুবকগণ, ওঠো, জাগো, শুভ মুহূর্ত সমাগত। সাহস অবলম্বন কর,ভয় পায়ও না। নির্ভীক হইতে হইবে,তবেই আমরা কার্যে সফলতা লাভ করিব।’ চীনের বিপ্লবী নেতা মাওসেতুং তরুণ বয়সেই চীনের বিপ্লবী কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন। ভিয়েতনামের যুবক হো চি মীন, কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও চে গুয়েভারা তারা তো কেউ বৃদ্ধ কিংবা শিশু ছিলেন না।তরুণ বয়সেই তারা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। আর আমাদের জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, উনি তো প্রথম সেই চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থাতেই কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে লিফলেট প্রচার করেছিলেন। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য থাকাকালীন উনার বয়স ছিল মাত্র ৩১ বছর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান বাস্তবতায় এমএন লারমার চেতনায় উদ্দীপ্ত একঝাঁক সৈনিকের বড্ড প্রয়োজন। প্রয়োজন এমএন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ একঝাঁক বুনোফুলের। শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ে বিভাজনের খেলা নতুন করে শুরু করেছে আরো নগ্ন হয়ে, আরো উন্মত্ত হয়ে। উগ্র এবং সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসমূহকে একে-অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড় করাতে মরিয়া রাষ্ট্রযন্ত্র। সভ্যতার উন্মেষের নামে তথাকথিত বনায়ন আর উন্নয়নের কবলে পড়ে সমগ্র পাহাড় আজ বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় লারমার চেতনাকে ধারণ করা তরুণদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে মাঠে নামতে হবে। এমএন লারমার চেতনা কি? সেই চেতনা, যে চেতনা আপোষ করে না, যে চেতনা পরাজয় মানে না। এমএন লারমার আদর্শ হচ্ছে সেই আদর্শ, যে আদর্শ জাতীয়তাবাদের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিকতায় পর্যবসিত হয়ে সমগ্র শোষিত-নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কথা বলে। আমাদের সেই চেতনার, সেই আদর্শের ধারক-বাহক হয়ে গড়ে ওঠার প্রয়াস করতে হবে। পাহাড়ের তারুণ্যের শক্তিকে রাষ্ট্র নানা দল-উপদলে ভাগ করে রেখেছে, পুঞ্জীভূত এই শক্তির সমারোহকে তারা একটি বিশেষ শ্রেণির সহায়তায় বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত করে রেখেছে। সেই মহাশক্তির সন্নিবেশ হওয়া দরকার এবং সেই সুমহান কাজটি এই তারুণ্যকেই নিতে হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভেদের জাল ছিন্ন করে এমএন লারমার চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় মুক্তির এই সুমহান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তবেই পূরণ হবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সেই স্বপ্নের, সেই স্বপ্নের জুম্মল্যান্ডের।