কণিকা চাকমা
১৯৩৯ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্যাকাশে এক ধ্রুবতারার জন্ম। তৎকালীন ক্ষয়িষ্ণু সামন্তীয় সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজালে আবদ্ধ নান্যাচরের মাওরুম গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল ও শিক্ষিত এক পরিবারে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
এই মহান নেতা সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখা সত্যি সত্যিই মহাধৃষ্টতার সামিল। তাই তাঁর যাপিত জীবন সম্পর্কে আলোচনা করতে নয়, বরং তৎকালীন সামন্তীয় সমাজব্যবস্থার অন্তরালে থেকেও তিনি কিভাবে তাঁর প্রদর্শিত পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে মুক্তির মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন সে সম্পর্কে জানা। তবে আমার মত নতুন প্রজন্মের কাছে মানবেন্দ্র লারমার জীবনাদর্শ সত্যি সত্যিই অত্যন্ত বিস্ময়কর ও অভাবনীয়। বলাবাহুল্য, সেই সময়ের সর্বস্তরের জনগণকে সংঘবদ্ধ করে বিপ্লবের মর্মার্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে জুম্ম জাতীয়তাবাদের জনক, পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় নিপীড়িত জনমানুষের একমাত্র আলোর দিশারি, এক মহান স্বপ্নদ্রষ্টাকে আমরা হারালাম চিরতরে সেই স্বার্থান্বেষী মহলের কালো শক্তির কাছে, যার আগুনে আজও পুড়ছে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের লক্ষ লক্ষ অসহায় জুম্ম জনগোষ্ঠী। তিনি শুধুমাত্র জুম্ম জনগোষ্ঠীর কথা নয়, বরং তৎকালীন সামন্তীয় সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন আপোষহীন কন্ঠে। অথচ সেই ষাটের দশকে অনেক শিক্ষিতদের কাছে যা ছিল অকল্পনীয় এবং এম এন লারমার দূরদর্শিতা ও প্রতিবাদ হয়ত অনেকের কাছেই দৌরাত্ম্য বলে মনে হয়েছিল সেই সময়।
বিশেষ করে ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক কাপ্তাই বাঁধের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের যে কোন ধরনের অভাবনীয় ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে তা তিনি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি জনসচেতনতা ও প্রতিবাদস্বরূপ মরণফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের উপর লিফলেট বিতরণ করেন এবং তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের রোষের শিকার হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় দুই বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। তিনি সেই সময় জেলে অন্তরীণ অবস্থায় আইন বিষয়ে পড়াশুনো করেন এবং এলএলবি পাশ করেন।
আজ প্রায় ষাট বছরের অধিক সময় পর আমরা নি:সন্দেহে বলতে পারি যে, তাঁর প্রদর্শিত পথের সঠিকতা ও যুগোপযোগিতা থাকবে ততদিন পর্যন্ত, যতদিন পর্যন্ত জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হয়। এম এন লারমা সেই প্রতিকূল সময়েও কত গভীরভাবেইনা জুম্ম জনমানুষের জন্য চিন্তা করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন, তা সত্যিই অভাবনীয়। তিনি জানতেন যে, অধিকার কেউ কাউকে এমনি এমনি দেয় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয়। আর তাইতো তিনি জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সর্বস্তরের মানষজনকে সংঘবদ্ধ করে শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘুমন্ত জুম্ম জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিলেন সেই জাগানিয়া আজো চলমান রয়েছে, ভবিষতেও জুম্ম সমাজের মধ্যে অনন্তকাল ধরে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা যদি এম এন লারমার কর্মজীবনের দিকে তাকাই, তাহলে নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, তাঁর মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা, সরলতা, আত্মবিশ্বাস, যৌক্তিকতা অন্যতম প্রধান গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। তিনি ‘ক্ষমা কর ভুলে যাও’ নীতিতে বিভেদপন্থীদের ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস যে, সেই ক্ষমা কর ভুলে যাও নীতির সুযোগেই পরবর্তীতে চার কুচক্রী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ গংদের হাতে খুন হন এই মহান ক্ষণজন্মা বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
তিনি তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি কতটুকু তার সহকর্মীদের বিশ্বাস করতেন। এমনকি, মৃত্যুর ঠিক আগে নাকি তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে মেরে যদি তোমরা এই অধিকারবঞ্চিত জুম্ম মানুষের অধিকার এনে দিতে পার, তবে আমাকে মেরে ফেল’। তিনি যে মৃত্যুর সন্নিকটে দাঁড়িয়েও জুম্মজাতির জন্য চিন্তা করে গেছেন তা বলাই বাহুল্য।
তিনি নারী অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথে নারী মুক্তি আন্দোলনকে সম্পৃক্ত করার গুরুত্ব গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আর তাইতো তিনি বলেছেন, নারীরও পুরুষের ন্যায় অধিকার ভোগ করা উচিৎ, তবেই নারীমুক্তি সম্ভব। এতেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানী ও দূরদর্শীতাসম্পন্ন একজন নেতা ছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালে জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করলে সকল গণতান্ত্রিক পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং এম এন লারমা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হন।
পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী সময়ে মহান নেতা এম এন লারমার যাপিত জীবন ও সংগ্রামের উপর মাত্র একটি স্মারকগ্রন্থ আমরা পেয়েছি। তাছাড়া তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক কিছু লেখা থেকে আমরা যারা নতুন প্রজন্ম তার থেকেই অতি সামান্যই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার স্বভাব, বিচক্ষণতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাই। তথাপি এই অতিকিঞ্চিৎ ধারণাকে অবলম্বন করে নতুন প্রজন্মকে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দূরদর্শিতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা, সর্বোপরি তাঁর জীবনাদর্শকে পাথেয় করে পথচলা আমাদের নতুন প্রজন্মের একান্ত কর্তব্য হওয়া উচিত।
বিশেষত আশির দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সমূলে নির্মূল করার যে পাঁয়তারা সেনাবাহিনী ও সরকার করছে তার বিপরীতে জুম্ম জনগণের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার স্বার্থেই এম এন লারমার জীবনাদর্শ ও প্রদর্শিত পথে পথচলা অপরিহার্য তা সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি। অন্যথায় আমাদের মত সংখ্যায় কম জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলীন হতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিশেষত এই পুঁজিবাদী সমাজবাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যা আরও দ্রুতগামী হচ্ছে। তাই নবপ্রজন্মের উচিৎ এম এন লারমার জীবনাদর্শকে ধারণ ও লালন করে ইতিহাসের ভাগ্যবিরম্বিত, নিপীড়িত, শোষিত জুম্মজাতির তিমির কালো রাত্রির অবসান করা। সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নবপ্রজন্মকেই তুলে নিতে হবে।