হিল ভয়েস, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, বান্দরবান: সরকার বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় জুম ভূমি ও গ্রামীণ বনের উপর তাদের অধিকার নিশ্চিত না করে লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের ভূমি বেদখলের পক্ষে নির্দেশ দিয়েছে।
গতকাল সোমবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের সচিব বিদর্শী সম্বোধি চাকমা স্বাক্ষরিত এক নিদের্শনায় “লামা রাবার ইন্ডাষ্টিজ লিমিটেডের ডলুছড়ি মৌজায় নতুন প্লান্টেশনের কাজ শুরু করার ব্যবস্থা এবং জরুরী ভিত্তিতে অবৈধভাবে জোরপূর্বক নির্মাণাধীন স্থাপনা সহ অন্যান্য সকল স্থাপনা অপসারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ”-এর জন্য বান্দরবান জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং লামা উপজেলার ইউএনও’কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অথচ ইজারা নেয়ার ১০ বছরের মধ্যে হর্টিকালচারের উদ্যোগ না নিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক সেসব ইজারা বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকার পার্বত্য চুক্তির সেই বিধান কার্যকর না করে উল্টো ভূমি বেদখলকারী লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের অভিযোগের ভিত্তিতে বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় ভূমি অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত জুম্মদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে।
এই নির্দেশনার মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণিত হলো, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পার্বত্যবাসীর স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা না রেখে সরকার পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও পার্বত্যবাসীর ভূমি অধিকারের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগেও ১৬ আগস্ট ২০২২, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর লামা রাবার ইন্ডষ্ট্রিজের পক্ষ অবলম্বন করে অভিমত দিয়েছিলেন এবং আদিবাসীদের পরিবার প্রতি মাত্র ৫.০ একর করে ভূমি বরাদ্দ করে বাকি অধিকাংশ জমি রাবার কোম্পানিকে দেয়ার পক্ষপাতমূলক প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর আগে গত শনিবার ২৪ সেপ্টেম্বর ভূমিদস্যু লামা রাবার কোম্পানির ইন্ধনে লামা থানার এস আই শামীমের উপস্থিতিতে রাবার কোম্পানির শ্রমিক কর্তৃক রেং ইয়ং ম্রোর কলাবাগানের ৩০০ কলাগাছ কেটে দেয়া হয়েছে। রেং ইয়ং ম্রো গত জুন জুলাই মাসে এসব কলাগাছ রোপণ করেন।
গত রবিবার ২৫ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে লামা থানার এসআই শামীম-এর নেতৃত্বে পুলিশের ৪ জনের একটি টিম সেখানে নির্মাণাধীন একটি স্কুল নির্মাণ কাজও বন্ধ করে দেয়। এ সময় তিনি ধমক দিয়ে বলেন, এখানে স্কুল নির্মাণ করতে হলে থানার ওসির অনুমোদন নিতে হবে।
পুলিশের হুমকিতে ভয় না পেয়ে গতকাল সোমবার সকাল থেকে স্কুল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করা হয়। নির্মাণ কাজে যুক্ত কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী গ্রামবাসী বলেন, প্রশাসন ও রাবার কোম্পানি মিলে আমাদের অধিকার হরণ করার যড়যন্ত্র আমাদের তিন পাড়ার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আমরা স্কুল নির্মাণ করেই ছাড়বো।
আদিবাসীদের অভিযোগ, সরই ইউনিয়নের সরই মৌজায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড ৪০ বছরের জন্য ৬৪ জনের নামে দুই মৌজায় (১৯৮৮-১৯৯৪) সর্বমোট ১৬০০ একর জমি লিজ নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩০০০ থেকে ৩৫০০ একরেরও বেশী ভূমি জবরদখল করে, যেগুলো আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় জুম ভূমি ও গ্রামীণ বন।
ভূমিদস্যুদের ভূমি জবরদখলের মুখে লামার সরই ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের আদিবাসীদের জীবন চলছে দারুণ সংকটে। কখনও জুম ভূমি পুড়িয়ে দেওয়া, কখনও ঝিরির পানিতে বিষ দেওয়া, কখনো ভূমিদস্যু রাবার কোম্পানি কর্তৃক মিথ্যা মামলা দায়ের, আবার কখনও কলাগাছ কেটে দেওয়া, কখনো ভূমি অধিকার কর্মীদের উপর হামলা, বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণে বাধা ও ভাঙচুর, পুলিশের সহায়তায় স্কুল নির্মাণে বাধা ও গ্রামবাসীর কলাবাগান ধ্বংস, সর্বশেষ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের ভূমি বেদখলের পক্ষে নির্দেশ প্রদান করা হলো।