হিল ভয়েস, ২৩ আগষ্ট ২০২২, ঢাকা: সাতক্ষীরা এবং উখিয়ায় আদিবাসীদের ওপর ভূমিদস্যুদের পরিকল্পিত হামলা, নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার যথাযথ বিচার ও চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে তিনটি সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকায় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (২৩ আগষ্ট) বিকেলে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত এই বিক্ষোভ সমাবেশে করেন সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামাই। সমাবেশে সঞ্চালনা করেন ডন জেত্ৰা।
সভাপতির বক্তব্যে অনন্ত বিকাশ ধামাই বলেন, “আমরা বাংলাদেশে ৪০ লক্ষ আদিবাসী বসবাস করছি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে যারা নীতি-নির্ধারক, যারা সংসদে যান এবং যারা সরকার পরিচালনা করেন তারাই আদিবাসী এলাকায় আদিবাসীদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে, এই আদিবাসীদেরকে হত্যা করছে।”
তিনি আরো বলেন, “গত ১৮ই আগস্ট উখিয়ায় চাকমাদের গ্রামে হামলা করা হয়েছে। সেখানে গুরুতরভাবে ৫ জন আহত হয়েছে। অপরদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডাকে হত্যা করা হলো। তাদের ইন্ধনদাতা কারা? সরকারি দলের যারা দালাল রয়েছে এবং সরকারি দলের ভূমিদস্যুরা এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত।”
আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হামলার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, “২০০ থেকে ৩০০ জন ভূমিদস্যু ধানের জমিতে মুন্ডাদের ওপর হামলা করেছে, জখম করেছে। সেখানে ৪০ জনের মতো মুন্ডা আদিবাসীরা আহত হয়েছে। নরেন্দ্রনাথ মুন্ডাসহ অন্যান্যদের আহত সাতক্ষীরা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারপর দিন নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা মৃত্যুবরণ করেন।”
তিনি আরো বলেন, “আজকে এই যে দিনে-দুপুরে পিটিয়ে মারল কিন্তু রাষ্ট্র আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করলো না। আদিবাসীদেরকে মারলে যে পার পাওয়া যায় এটাই আসলে আমরা এই ঘটনায় দেখতে পেলাম।”
সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল। সংহতি বক্তব্যে তিনি বলেন, “সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মুন্ডা পাড়ায় ২২টি পরিবার রয়েছে। দিনে দুপুরে ওই স্থানে আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের নেতা কর্মীরা তাদের ওপর হামলা করেছে। দেশে কি আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু আছে নাকি আইন-শৃঙ্খলা শুধু আওয়ামী লীগের জন্য, ছাত্রলীগের জন্য?”
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তিনি আরো বলেন, “আজকে আমরা যাদের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ বলি বা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ বলি, তাদের ওপর যখন শোষণ করা হয় তখন আপনারা কেবল তাকিয়ে দেখেন। আপনারা আওমীলীগের পক্ষে দাঁড়ান, ছাত্রলীগ-যুবলীগের পক্ষে দাঁড়ান কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে পুলিশ প্রশাসনও দাঁড়ায় না।”
উখিয়ায় হামলার কথা উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, “মনখালী চাকমা পাড়ার সর্বমোট ২০ জন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। এই ঘটনাটি ঘটেছে যখন এই চাকমা আদিবাসীরা সরকারের সম্পত্তি সামাজিক বনায়নকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছে। দখল করার খবর বনবিভাগকে দেয়ার অপরাধে তাদের উপর হামলা করা হয়েছে।
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আজকে ৫ দিনের অধিক সময় হয়ে গেল যারা হামলা করল তাদের প্রতি কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে দেখলাম না। অপরদিকে যারা সরকারের সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে ভূমিদস্যুদের হামলার শিকার হলো, তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা হয়নি। পরদিন (১৯ আগস্ট) সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুণ্ডাপাড়ায় মুণ্ডা আদিবাসীদের ভূমি দখলের চেষ্টা হয়েছে। মুণ্ডারা দখল প্রতিরোধ করতে গেলে ভূমিদস্যু দুর্বৃত্তরা তাঁদের ওপর হামলা করে। এ হামলায় আহত নরেন্দ্রনাথ মুণ্ডা পরদিন মৃত্যুবরণ করেন। মূলত প্রশাসনের নীরবতা ও ভূমিদস্যুদের পক্ষাবলম্বনের কারণে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভূমিগুলো বেদখল হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
এরপরে যোগ করে তিনি বলেন, ২৪ বছরেও পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু চুক্তি করা সরকারের কৃতিত্ব হতে পারে না, চুক্তির বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই তারা কৃতিত্ব নিতে পারে। তিনি সরকারের কাছে পার্বত্য চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণাসহ, সমতলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার রক্ষায় স্বাধীন ভূমি কমিশন ও পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে চা-শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান বলেন, “যুগের পর যুগ ধরে এদেশের আদিবাসীদের নিপীড়ন নির্যাতন দমন-পীড়নের মাধ্যমে আমাদের আদিবাসীদের অস্তিত্ববিহীন করার জন্য পায়তারা এবং ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমাদের এই দেশের সাধারণ শ্রমিক, মেহনতি মানুষ আজ হাহাকার করছে। তারা তাদের নূন্যতম মজুরির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করছে। রাষ্ট্র স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা নূন্যতম অধিকারটুকু পাই না।”
তিনি আরো বলেন, “দুঃখের সাথে বলতে চাই, এ দেশের একজন মানুষকে দিনে-দুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কিন্তু পিটিয়ে হত্যার বিচার পাই না। রাষ্ট্রে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির চলছে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা বেশি দিন চলতে দিতে পারি না।”
উক্ত সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ, নারী অধিকার কর্মী রাখি ম্রং, যুবনেতা হরেন্দ্র নাথ সিং, ছাত্রনেতা নাঈম হাজং প্রমুখ।