হিল ভয়েস, ৫ আগস্ট ২০২২, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সরকারের আদিবাসী বিরোধী প্রজ্ঞাপন বাঙালীকরণে অংশ।
আজ ৫ আগস্ট ২০২২ বিকাল ৩:৩০ ঘটিকায় চট্টগ্রামে পিসিপি’র চট্টগ্রাম মহানগর শাখা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ও পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের যৌথ উদ্যোগে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে এবং সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশনার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
পিসিপি’র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নরেশ চাকমার সঞ্চালনায় ও চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যার সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি তাপস হোড়। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সদস্য রুমেন চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগর সংসদের সভাপতি এনি সেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি মিরাজ উদ্দীন, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমা ও সহ-সভাপতি দিশান তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হ্লামিউ মারমা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সুখী কুমার তঞ্চঙ্গ্যা। এছাড়াও সমাবেশে সংহতিমূলক বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থী তিপন তঞ্চঙ্গ্যা ও মাছেনহ্লা রাখাইন। স্বাগত বক্তব্যে রাখেন পিসিপি’র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সুখী কুমার তঞ্চঙ্গ্যা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাপস হোড় বলেন, বাংলাদেশে আদিবাসী আগেও ছিল, এখনও আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে। আদিবাসীদের নিয়ে পাকিস্তান আমল থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তীতে সরকার একের পর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে আদিবাসী কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। এইসব প্রজ্ঞাপন সংখ্যালঘু আদিবাসীদের নিজ পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে বাঙালীকরণের মতো ঘৃণ্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। এদেশের আদিবাসীদের ন্যায্য দাবি, ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য এখনও পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তি অনুসারে এখনো পর্যন্ত শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়নি। একটি রাষ্ট্রে একক কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী থাকতে পারে না। সংখ্যায় কম আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের অধিকার নিশ্চিত করে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সন্তু লারমার নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয় সেটা সন্তু লারমার পরে এই যুবসমাজকে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে যেতে হবে। এছাড়াও তিনি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের আশ্বাস দেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পক্ষ থেকে রুমেন চাকমা বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে আজো আমাদের জাতিগত পরিচয় আদায়ে আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরা কী পরিচয়ে বেঁচে থাকতে চাই তা সরকার এখনো আড়ালে রাখতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক নীতি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করছে এবং নানা বৈষম্যের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সারাবিশ্বে আদিবাসীদের স্বীকৃতিসহ তাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সম্মান রেখে বিভিন্ন দেশে আদিবাসী দিবস পালন করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এই ‘আদিবাসী’ শব্দটি স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। যে আওয়ামীলীগ দল ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে আদিবাসী শব্দ সগৌরবে ব্যবহার করেছিল সেই তারা নাকি ২০১১ সালে এসে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। এছাড়াও তিনি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ীভাবে চালিয়ে যেতে সকলকে আহ্বান জানান।
ছাত্রনেতা এনি সেন উল্লেখ করেন, একসময় আওয়ামী লীগ সরকার আদিবাসী অধিকার নিয়ে কথা বললেও বর্তমান শাসনক্ষমতায় এসে আদিবাসী অধিকার বিষয়ে নিশ্চুপ। দেখা যাচ্ছে, শাসন ক্ষমতায় যেই দল আসে তারা আদিবাসীদের কথা ভুলে যায়। সরকার বিশ্বের দেশে-বিদেশে আদিবাসীদের উপভোগ্য ছবি দেখিয়ে সুনাম কামায়, অথচ দেশের ভেতরে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। তারা আদিবাসীদের আত্মপরিচয় লুকানোর চেষ্টায় মত্ত।
তিনি আরো বলেন, আজকে পার্বত্য চুক্তির ২৪ বছর পরেও সরকার তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না করে নানা দল-উপদল সৃষ্টি করে পাহাড়ে সংঘাত জারি রেখেছে। পাহাড়-সমতলে যতদিন পর্যন্ত আদিবাসীদের আর্তনাদ থামবে না, যতদিন বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান তিনি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মিরাজ উদ্দীন বলেন, আপনারা এদেশের আদিবাসী তা রাষ্ট্র স্বীকার করছে না। যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেক জাতিসত্তার তার জাতিগত পরিচয় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমা বলেন, আমরা এখন আত্মপরিচয়ের সংকটে ডুবে আছি। মূলধারার উন্নয়ন কাঠামো আদিবাসীদের দেশান্তরি হতে বাধ্য করছে, উচ্ছেদ হতে বাধ্য করছে। সরকার এভাবে আদিবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আমরা যার যার জাতিগত পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই।
চবি’র ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক প্রত্যয় নাফাক তার বক্তব্যে বলেন, আজকে আমরা এমন সময়ে জড়ো হয়েছি যখন মধুপুরে পিতৃভূমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্রো’দের ভূমি দখল করে পর্যটন-রিসোর্ট বানানো হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রজ্ঞাপনটা দেওয়া হয়েছে তা কতটুকু যৌক্তিক তা বিবেচনার বিষয়। তারা যেখানে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ সেই জায়গায় আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করতে মেতে উঠেছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতা লুকিয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এছাড়া তিনি আদিবাসী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের সংহতির কথা বলেন।
হ্লামিউ মারমা বলেন, সরকার নিজেই ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে। যার মধ্যে নিহিত আছে তাদেরকে বাঙালীকরণের হীন প্রচেষ্টা ও পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা। তিনি আরো বলেন, উপজাতি বলতে পৃথিবীর কোথাও জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। সংখ্যার দিক দিয়ে বিবেচনা করে জাতি নির্ধারিত হয় না যেটা বাংলাদেশ সরকার নিজের স্বার্থেই করে বেড়াচ্ছে।
সাধারণ শিক্ষার্থী তিপন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান রচনাকালের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যেখানে যার যার জাতিগত ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যকে শ্রদ্ধার কথা বলা হয়। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আদিবাসী বিদ্বেষী প্রজ্ঞাপন তার উল্টো ভূমিকা পালন করছে। আমরা আদিবাসীরা এদেশে হীন রাজনীতির শিকার হচ্ছি বারবার। সরকার তার হীন উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য আদিবাসী শব্দের বিরোধিতা করে আসছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাছেনহ্লা বলেন, আমরা কেনো আদিবাসী তা ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়। সরকার যে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, উপজাতি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করছে তা অমূলক ও আমাদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করার জন্য।
সভাপতির বক্তব্যে সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, সরকারের প্রতি প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের উদাত্ত আহবান জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জুলাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার নির্দেশ জারি করা হয়। এছাড়াও গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী মহলে এই শব্দ ব্যবহার না করার কড়া আদেশ দেওয়া হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকান্ডে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র সংগঠন, অধিকার কর্মী ও সচেতন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করেন।