হিল ভয়েস, ১৭ আগস্ট ২০২২, বান্দরবান: বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীর সাথে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর সৃষ্ট ভূমি বিরোধ নিয়ে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা কোন মীমাংসা ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল ১৬ আগস্ট ২০২২ বেলা ১১:৩০ টার দিকে ভূমি বিরোধ নিয়ে অসন্তোষ ও বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সভাকক্ষে উক্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীর প্রতিনিধি এবং ভূমি দস্যূ খ্যাত লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর প্রতিনিধিগণসহ জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সভায় পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীদের দাবিকৃত তাদের ঐতিহ্যগত ৪০০ একর পাড়া ও জুমভূমির বিপরীতে পরিবার প্রতি মাত্র ৫ একর ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব/রায় দিলে আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরা প্রতিনিধিবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ম্রো ও ত্রিপুরা প্রতিনিধিবৃন্দ পার্বত্যমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের উক্ত রায়/প্রস্তাবকে একতরফা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেন। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ও মীমাংসা ব্যতিরেকেই সভাটি সমাপ্ত হয় বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সভায় ক্ষতিগ্রস্ত ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভূমি রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রংধজন ত্রিপুরা, যুগ্ম আহ্বায়ক জয়চন্দ্র ত্রিপুরা (সাবেক কার্বারি), রেংইয়েন কারবারি, লাঙকম ম্রো (কারবারি), জোহান ম্রো, বৈসুরাম ত্রিপুরাসহ অন্তত ২৫ জন।
অপরদিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন, প্রকল্প পরিচালক কামাল উদ্দিন এবং অন্যান্যরা।
জানা গেছে, সভায় মন্ত্রী বীর বাহাদুর প্রথমে রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক পরিবার প্রতি ৫ একর জায়গা প্রদানের যে আশ্বাস তা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ‘এটা সকলের জন্য ভালো হবে এবং কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না’ বলে মতামত দেন।
পার্বত্য মন্ত্রীর উক্ত মতের জবাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে রংধজন ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা এ রায় মানি না। রাবার কোম্পানির ১,২০০ একর জায়গা মাপা হোক। আমাদের ৪০০ একর আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হোক।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত ১০ আগস্ট নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে হামলা, ভাংচুর ও বুদ্ধমূর্তি লুট করার ঘটনাটিও মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় টু শব্দ করেনি। উল্টো আমাদেরকে ধমক দিয়েছেন।’
জানা গেছে, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর কর্তৃপক্ষ ভাড়াটে ভূমিদস্যুদের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লামার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারী পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারী পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারী পাড়ার আদিবাসীদের অবশিষ্ট ৪০০ একর জুমের বাগান এবং ভূমি বেদখল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ম্রো ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই তিন আদিবাসী গ্রামের ৩৯টি পরিবারের ২০০ নারী-পুরুষ এখন উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছেন।
গ্রাসবাসীরা জানান, তাদের গ্রামের প্রায় ৪০০ একর ভূমিতে তারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ ও বাগান-বাগিচা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে হঠাৎ লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানী রাবার প্লটের নামে জুম্মদের ঐসব ভূমি দখলে নেয়ার অপচেষ্টা শুরু করে। এসময় গ্রামবাসীরা বাঁধা দিলে, কোম্পানির লোকেরা জুম্মদের মামলা, হামলা, খুন ও পুলিশের ভয় দেখায়। তখন থেকে কোম্পানির লোকেরা একাধিকবার শ্রমিক এনে জুম্মদের ঐ ভূমি বেদখলের চেষ্টা করে।
ইতোপূর্বে সরই ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার নতুন পাড়া, ঢেঁকিছড়া পাড়া ও নোয়া পাড়ায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড ইজারার নামে ১,৬০০ একর জায়গা দখল করে। এর ফলে এলাকার তিনটি গ্রামের শত শত পরিবার ম্রো গ্রামবাসী উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
উল্লেখ্য, রাবার কোম্পানির ভূমিদস্যুদের কর্তৃক গত ৯ এপ্রিল ২০২২ স্থানীয় ম্রো ও ত্রিপুরাদের প্রায় ৪০০ একর জুম ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের বিভিন্ন ফলজ গাছসহ অন্যান্য চারা ও গাছ কেটে দেয়া হয় এবং ২৬ এপ্রিল ২০২২ জুম ভূমি ও গ্রামীন বনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর গত ১৩ জুলাই ২০২২ ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী নেতা রংধজন ত্রিপুরাকে ডলুছড়ি মৌজার হেডম্যান কার্যালয়ে হামলা করে গুরুতর আহত করা হয়। গত ১০ আগস্ট ২০২২ বিকাল আনুমানিক ৩:০০ টার দিকে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভাড়াটে ভূমিদস্যুদের কর্তৃক রেংইয়েন কার্বারি পাড়ার নবনির্মিত অশোক বৌদ্ধ বিহারে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও দুটি বুদ্ধিমূর্তি লুট করা হয়।
এমতাবস্থায় গতকাল ১৬ আগস্ট ২০২২ বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভুক্তভোগী ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসী এবং রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড এর প্রতিনিধিদের নিয়ে পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুরের সভাপতিত্বে উপরোক্ত সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩ ঘন্টা ব্যাপী এই সভা চললেও শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা হয়নি বলে জানা যায়।