অভিষেক চাকমা
১. শান্তিবাহিনীর প্রত্যাগত এক সদস্য একদিন বলেছিলেন, ‘শান্তিবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে অনেক নিরাপদে ছিলাম। অন্তত জীবনের নিরাপত্তা ছিল। চুক্তির পরবর্তী সময়ে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসার পর দেখেছি জীবনের নিরাপত্তা নাই’। রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়িতে প্রতিদিন চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের হাতে কেউ না কেউ অপহরণ, হত্যা আর মারধরের শিকার হতো। শত শত সেনা, পুলিশ, বিডিআরের ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও তারা কখনো আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বরঞ্চ, বেশিরভাগ জায়গায় সেনাবাহিনী চুক্তি বিরোধীদের সহযোগিতা করেছে, নির্বিকার চেয়ে থেকেছে। তৎকালীন বাস্তবতায় বলা যায়, প্রশাসন একপ্রকার চুক্তি বিরোধীদের হত্যা, অপহরণ, মারধর আর গুমের লাইসেন্স দিয়েছিল। সেসময়ে কোনো বাঙালি অপহৃত হলে তাকে এক দুই দিনের মধ্য প্রশাসন উদ্ধার করে আনত। কিন্তু কোনো পাহাড়ি অপহৃত হলে, খুন হলে, গুম হলে বলত এটা পাহাড়িদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সে সময়ে নাকি অনেক ভালো সেনা অফিসারও ছিল। বলা যায় সংখ্যায় তারা হাতে গোনা। সেসময়ে তারা চুক্তিবিরোধীদের হামলার তথ্যগুলো দিতেন বলে অনেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তীতে এমন দিন যায়নি যে, যেদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রত্যাগত শান্তিবাহিনীর সদস্য, জেএসএস এবং তার কর্মী সমর্থকদের ওপর হামলা করেনি। প্রত্যেকটা দিন কাটতো খুব উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে দিয়ে। সারাক্ষণ পালিয়ে বেড়াতে হতো। চুক্তি বিরোধীদের দৌরাত্ম্য সহ্য করতে না পেরে নিজেদের আত্মরক্ষার্থে জুম্ম জনগণ এবং জেএসএসের অনেক নেতা-কর্মী নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। বাধ্য হয়ে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে একটা সশস্ত্র দল গড়ে তোলে। যে সশস্ত্র দলের সাথে জনসংহতি সমিতির কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। এটা তারা নাম দিয়েছে প্রতিরোধ সংগ্রাম তথা আত্মরক্ষার সংগ্রাম। যে প্রতিরোধ সংগ্রাম তারা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে বলে থাকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে চলমান এ সংঘাত বন্ধে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ ও সমসাময়িক গ্রুপগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং চুক্তি পরবর্তীতে চুক্তি বিরোধীদের প্রতিরোধ গড়ে তোলা চুক্তি সমর্থকরা দীর্ঘসময় ধরে আহ্বান করে আসছিল। তাদের সশস্ত্র অবস্থান ত্যাগ করে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে চুক্তি বাস্তবায়নের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে ফিরতে ইউপিডিএফের নেতৃত্বকে বারংবার অনুরোধ করা হয়ছিল। এমনও বলা হয়েছিল যে, ইউপিডিএফ সশস্ত্র কার্যক্রম থেকে সরে আসলে চুক্তি পক্ষের আত্মরক্ষার কোনো ভিত্তি থাকার কোন প্রশ্নই আসবে না, ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক গতিতে এই সংঘাতের সমাধানও চলে আসবে। কিন্তু জেএসএস এবং চুক্তি পক্ষীয় সশস্ত্র দলের সেই আহ্বান তাদের সর্বস্তরের কর্মীরা কখনো মানেনি এবং সে ব্যাপারে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় কমিটি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ, জেএসএস এবং চুক্তি পন্থী সশস্ত্র দলের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, খুন, গুম এবং অপহরণের মতো জঘন্য কার্যক্রম ইউপিডিএফ পুরোদমে জোরদার করে। নিচে কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে সেটার বাস্তবতা পরিষ্কার করছি:
ক. ১৯৯৮ সালের ২৪ মে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন হলে এর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে বেতছড়ি নামক ওই একই স্থানে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার গাড়ির বহরে প্রথমবারের মতো ইউপিডিএফ সশস্ত্র হামলা চালায়।
খ. ১৯৯৮ সালের ১৩ জুন জনসংহতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সত্যবীর দেওয়ানসহ জনসংহতি সমিতির ৪ জন সিনিয়র সদস্যকে অপহরণ করে। অপহরণের পর তাদের অমানুষিক হয়রানি করার পর মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
গ. ২০০৬ সালের ৫ জানুয়ারি ইউপিডিএফ’র তথ্য বিভাগের এক বিবৃতিতে চার মাসের জন্য জনসংহতি সমিতির প্রতি ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। সে সময় সমিতির কথিত অবৈধ অস্ত্র-শস্ত্র ইউপিডিএফ’র কাছে জমা দেয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছিল বিবৃতিতে।
ঘ. ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা ও চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায়ের গাড়ির বহর লক্ষ্য করে গুলি ও ইটপাটকেল ছোড়ে। তিন দফা হামলায় সন্তু লারমা ও রাজা দেবাশিষ রায়ের গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। তারা দুজন অক্ষত থাকলেও চারজন ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী এতে আহত হন।
ঙ. ২০১২ সালের ২০ মে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে রাঙ্গামাটি সদরের কল্যাণপুর পেট্রোল পাম্পের কাছে বাসের জন্য অপেক্ষামান ছাত্রদের ওপর চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় গ্রেনেড হামলা করে। সে হামলায় মংচসিং মারমা নামে এক পিসিপির কর্মী নিহত হয় এবং ৮/৯ জন গুরুতর আহত হয়।
চ. ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশ থেকে ফেরার সময় ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ৭০ নেতা-কর্মীকে অপহরণ করার পর ব্যাপক নির্যাতন করে। দফায় দফায় আলাপ আলোচনার পর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অপহরণ নাইজেরিয়ার বোকো হারামের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকেও হার মানিয়েছিল। এশিয়ার ইতিহাসে বোধহয় এটাই সবচেয়ে বড় অপহরণের ঘটনা ছিল।
এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করা জনসংহতি সমিতি, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর তারা কি না করেনি! দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ দীর্ঘ ২৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও ইউপিডিএফ তার অবস্থান থেকে একচুলও সরে আসেনি। এটার জন্য সাধারণ জুম্ম জনগণের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মনে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বা সমালোচনা করার প্রত্যেকেরই গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু এ চুক্তিকে বিরোধিতা করতে গিয়ে জনসংহতি সমিতিকে বা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ ও বানচাল করা কখনোই গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচায়ক হতে পারে না। এটা স্রেফ হঠকারী, আত্মঘাতী, অগণতান্ত্রিক, বিভেদকামিতা বৈ কিছু নয়। সংঘাত বন্ধ করতে হলে, ইউপিডিএফকে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে মুক্তিপণ, খুন, গুম, অপহরণ বানিজ্যসহ সকল প্রকার জুম্ম স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। অন্যথায়, জুম্ম জনগণ, চুক্তিপন্থী সশস্ত্র দল এবং জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীরা তাদের আত্মরক্ষার জন্য এবং চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের স্বার্থে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাধ্য হবে। এছাড়া তাদের কোনো বিকল্প পথ নেই।
জনগণ তথা চুক্তি সমর্থকদের প্রাণ বাঁচানোর এ সংগ্রাম তথা আত্মরক্ষার জন্য চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বলে ব্যাখ্যা করা অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন ও অনভিপ্রেত। বিজ্ঞজন এবং সচেতন মহলের উচিত, জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে ইউপিডিএফকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে বেড়িয়ে আসতে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অন্যথায় আমাদের আপনাদের সেই অনাকাঙ্খিত সংঘাত বন্ধ হবে না।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও অধিকার কর্মী