হিল ভয়েস, ১৩ আগস্ট ২০২২, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩৭৯নং বাঘাইছড়ি মৌজাস্থ উগলছড়ি হতে কজইছড়ি পর্যন্ত ৩০ ফুট প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ কাজ বাতিল করার দাবিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৫৬ আদিবাসী জুম্ম পরিবার প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রেরণ করেছেন বলে জানা গেছে।
গত ৯ আগস্ট ২০২২ রাঙ্গামাটি জেলার ডেপুটি কমিশনারের মাধ্যমে ৫৬ পরিবারের পক্ষ থেকে ৫৬ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত এই স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি’র সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সংসদ সদস্য, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, চাকমা সার্কেলের চীফ, চট্টগ্রাম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এর নিকটও স্মারকলিপি’র অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করা লেখা এই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীগণ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড এবং ৩৭৯নং বাঘাইছড়ি মৌজাস্থ উগলছড়ি ও কজইছড়ি গ্রামের চাকমা জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসী হই। উল্লেখ্য যে, আমরা প্রায় ৬০টি পরিবার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের বহু পূর্বে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে লংগদু, দীঘিনালা, বাঘাইছড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ৩৭৯নং বাঘাইছড়ি মৌজাস্থ উগলছড়ি ও কজইছড়ি গ্রামের বসবাস ও চাষের অনুপযোগী পাহাড়ি জায়গাকে বহু কায়িক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করে চাষযোগ্য ও বাসোপযোগী করে তুলি। আমরা ৩৭৯নং বাঘাইছড়ি মৌজাস্থ উগলছড়ি ও কজইছড়ি গ্রামে প্রায় ১০০ (একশত) একর জমিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর নিকট হতে রাবার চারা ও কৃষি অধিদপ্তরের নিকট হতে বিভিন্ন বিভিন্ন ফলজ চারা অনুদান হিসেবে সাহায্য গ্রহণ করে রাবার ও বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বাগান সৃজন করি। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, আমরা নিজেরা নিজস্ব অর্থায়নেও আগর ও সেগুন চারা রোপণ করে আগর ও সেগুন বাগান সৃজন করি। আমরা উক্ত বাগান হতে বিভিন্ন মৌসুমী ফল বিক্রি করে পরিবার পরিজন নিয়ে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। আমাদের জনসাধরণের চলাচলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে বিগত ২০২০-২০২১ সালের অর্থ বছরে আমাদের সৃজিত বাগান হতে জমি নিয়ে ১০ ফুট ব্রিক সলিং রাস্তা নির্মাণ করা হয় এবং আমাদের জায়গার উপর উক্ত রাস্তা নির্মাণের বিপরীতে আমাদের কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় নাই।”
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, “বিগত কয়েকদিন আগে স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা ব্যতিরেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক বিগত ২০২০-২১ সালের অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত ১০ ফুট রাস্তাকে সম্প্রসারণের নামে কোনো প্রকার যৌক্তিকতা ব্যতিরেকে বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে রাস্তার উভয় পাশে আরও ১০ ফুট করে মোট ৩০ ফুট রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ শুরু করে। কারণ আমাদের চলাচলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত ১০ ফুট রাস্তা বিদ্যমান থাকার পরও কোনো প্রকার যৌক্তিকতা ব্যতিরেকে উক্ত রাস্তা প্রশস্তকরণের ফলে আমাদের অতিকষ্টে সৃজিত বাগান ও বসতভিটা এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাছাড় উক্ত রাস্তাটি প্রশস্তকরণের ফলে আমাদের বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও রাবার গাছ কাটার ফলে পরিবেশের চরম ক্ষতির সৃষ্টি হবে এবং পাহাড় কেটে রাস্তা প্রশস্তকরণের ফলে বর্ষার মৌসুমে আমাদের এলাকায় পাহাড় ধ্বসের সম্ভাবনা জোরালোভাবে বিদ্যমান।
তাই স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা ব্যতিরেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক বিগত ২০২০-২১ সালের অর্থবছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ১০ ফুট রাস্তাকে প্রশস্তকরণের নামে কোনো প্রকার যৌক্তিকতা ব্যতিরেকে বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে উভয় পাশে আরো ১০ ফুট করে মোট ৩০ ফুট রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ বাতিল করার জন্য আমরা বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।”
উল্লেখ্য, গতকাল ৩১ জুলাই ২০২২ সকাল ১০:০০ টায় ২৭ বিজিবি মারিশ্যা জোনের জোন কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ শরিফুল আবেদ (এসজিপি) নিজে এসে এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন। এর পরপরই তার উপস্থিতিতেই সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন এর সদস্যরা আর্য্যপুর বনবিহারের রাস্তার মুখ এলাকায় বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে জোরপূর্বক আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীর দোকান ও মূল্যবান গাছ ধ্বংস করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
এই সময় বাঘাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলিভ চাকমার নেতৃত্বে স্থানীয় জুম্ম গ্রামবাসী জোন কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ শরিফুল আবেদ (এসজিপি) এর নিকট জুম্মদের ব্যাপক ক্ষতি করে এই সড়ক নির্মাণ কাজের প্রতিবাদ জানান এবং কাজটি বন্ধ করার দাবি জানান। কিন্তু বিজিবি ও সেনা সদস্যরা স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ ও দাবিকে তোয়াক্কা না করে সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, উগলছড়ি এলাকার আর্য্যপুর দোকানের রাস্তা মুখ থেকে কজোইছড়ি মুখ পর্যন্ত আনুমানিক ৪ কিলোমিটার দুরত্বের রাস্তা নির্মিত হবে এবং এতে কমপক্ষে ৬০ পরিবার জুম্ম গ্রামবাসী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই রাস্তা নির্মাণের ফলে জুম্ম গ্রামবাসীর রেকর্ডীয় জায়গার পরিমাণ ৪.৮৫ একর, ভোগদখলীয় জায়গার পরিমাণ ৭.২০ একর এবং ধান্য জমি ১.০০ একর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ডিপ টিউওয়েল ২টি, বাড়িঘর ১৩টি, দোকান ৩টি, গোয়ালঘর ২টি, তামাক চুলা ১টি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর অন্যান্য আগর ও সেগুনসহ বিভিন্ন মূল্যবান প্রজাতির হাজার হাজার গাছ ধ্বংস হবে।
উল্লেখ্য যে, সীমান্ত সড়ক (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে এই রাস্তাটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পের নথি অনুসারে উক্ত সীমান্ত সড়কটি ৩১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য হবে। উক্ত সড়ক নির্মাণের ফলে ইতোমধ্যে শত শত জুম্ম পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং আরো অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি, বাগান-বাগিচা ও ঐতিহ্যগত জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে রয়েছে বলে জানা গেছে।