মিতুল চাকমা বিশাল
পূর্বেকার সময়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই পাহাড়কে প্রাকৃতির সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি, বৈচিত্র্যের জনপদ এবং বাংলাদেশের এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে উপস্থাপনের চর্চা ছিল। সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এখানকার মানুষগুলো দেশের সংখ্যালঘু বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে সবদিক দিয়েই যে পৃথক, তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে স্বল্প পরিসরে হলেও উপস্থাপনের এক চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়াতে কিংবা খবরের কাগজের মলাটে মলাটে পাহাড়ের সৌন্দর্য্য এবং এখানকার আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে প্রমাণ্যচিত্র তৈরি করা হত, লেখালেখি হত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় তা এখন ইতিহাসের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। কথায় বলে সৌন্দর্য্য বড় ক্ষণস্থায়ী। পাহাড়ের বাস্তবতাও আজ ঠিক তেমনই হয়েছে। এখন আর সেসবের চর্চা তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু বাস্তব সত্য এটাই যে, পাহাড়কে নিয়ে এই যে উপস্থাপনের রাজনীতি চলমান রয়েছে কালের পরিক্রমায়, তা বরাবরই শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশিত পথেই চলেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র যেভাবেই পাহাড়ের উপস্থাপন চেয়েছে, ঠিক সেভাবেই পাহাড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাস্তবিক অর্থে পাহাড়ের সৌন্দর্য্যকে উপস্থাপনের পিছনেও রাষ্ট্রের স্বার্থবাদী রাজনীতি জড়িত ছিল। উদ্দেশ্য এটাই যে, দেশের সমতল অঞ্চলের ভূমিখেকো আর কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া। তাদের উপস্থাপনের ধরনটি এমনই ছিল যে, এখানকার ভূমিগুলো এমনিতেই পড়ে আছে, এগুলোর ব্যবহার করে পুঁজি বাড়ানো চায়। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে ব্যবসায়িক বন করতে হবে, খালি পড়ে থাকা পাহাড়ে পর্যটন গড়ে তুলতে হবে। এখানে পড়ে আছে দেশের এক দশমাংশ ভূমি, অথচ লোক আছে অতি অল্প। এই জন্য পাহাড়ের প্রকৃত বাস্তবতাকে আড়াল করে পাহাড়কে বরাবরই সম্ভাবনাময় হিসেবে উপস্থাপন করে,বহিরাগতদের আকৃষ্ট করার ঘৃণ্য রাজনীতি চর্চা হয়েছে। বৈচিত্রতা নিয়ে যে উপস্থাপনের রাজনীতির চর্চা হয়েছে, সেটি হচ্ছে এই মানুষগুলো খুবই সাধারণ, সহজ-সরল ও নিরীহ এবং এরা বাংলাদেশের বাইরের লোক, এরা আদিম, এরা বর্বর, সভ্যতার ধারেকাছে এরা নেই বলে তুলে ধরা। তাই তাদেরকে সভ্য করতে হবে।
কিন্তু কিভাবে? উন্নয়নের ঠেলায়। বাঁশের সাঁকোর পরিবর্তে তাই ঝিরি-ঝর্ণার পাথরগুলোকে তুলে এনে পাথরের কংক্রিট আর সিমেন্টের প্রলেপ মেশানো সেতু বানানো হলো, বাহারী রঙের কালভার্ট বানানো হলো। বিনিময়ে ঝিরি-ঝর্ণার জল শুকিয়ে পাহাড়িরা উদ্বাস্তু হয়েছে, পানীয় জলের অভাবে, খাদ্যের সংকটে। প্রথাগত ও গোষ্ঠীগত ভোগদখলীয় কোন সামাজিক পাহাড়ি চূড়াতে পর্যটন বানিয়ে দেওয়া হলো, যেন মেঘেদের রাজ্য ঘুরে আসা যায়। যেখানে মেঘ এসে আলতো করে ছুঁয়ে যেতে পারে, আর মেঘেদের আঁড়ালে, পর্যটনের স্রোতে হারিয়ে যায় পাহাড়ের একেকটি গ্রাম। সভ্যতার ধ্বজাধারীরা পাহাড়কে না জেনেই পাহাড়কে আঘাত করেছে, পাহাড়ে তথাকথিত উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে পাহাড়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। উন্নয়নের জোয়ারে পাহাড়ের বনভূমি উজার হয়ে গেছে। সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক হয়েছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর পাহাড় লুন্ঠনের সুবিধার্থে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা, সেই সমস্যার বিভিন্ন দিকের মধ্যে রয়েছে ভূমি সমস্যা, সামরিকায়ন ও ইসলামিকরণ, বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ও বহিরাগতদের সমতলে পুনর্বাসন, পর্যটন, উন্নয়নসহ নানাবিধ সমস্যা। এ সমস্যাগুলোর প্রত্যেকটির একেকটা রাজনৈতিক চরিত্র আছে, যার মূলে রয়েছে পাহাড়িদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পাহাড়িদের দাবিয়ে রাখা। তবে এসমস্ত সমস্যাগুলোর অধিকাংশই ভূমি সমস্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূমিকে ঘিরেই সমস্ত কিছু আবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভূমি সমস্যার সাথে সেনা-সেটেলার বিষয়টির এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টিতে এই দুইটি অংশের ভূমিকা একেবারেই বর্ণনাতীত। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পূনর্বাসিত সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈধতা দিতে রাষ্ট্রযন্ত্র বরাবরই মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চলমান রেখেছে। যেহেতু এতগুলো পরিবারকে এখানে বসতি প্রদান করা হয়েছে, তার সবগুলোই পাহাড়িদের ভূমিকে জবরদখল করেই করা হয়েছে।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাতে যত্রতত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণের ফলে এবং সেনাবাহিনী ও বহিরাগত সেটেলারদের আক্রমণে উচ্ছেদ হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম এবং দখল করা হয়েছে পাহাড়িদের ভোগদখলীয় ভূমি। সেনাবাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণের ফলে দখল হয়েছে প্রায় ৭২,০০০ একর ভূমি, যার অধিকাংশই বান্দরবান জেলায়। একইভাবে পর্যটন, উন্নয়ন এবং অবৈধভাবে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হাজার হাজার একর ভূমিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে এবং নতুন করে বহিরাগতদের জন্য ভূমি বন্দোবস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই ভূমির পরিমাণ প্রায় ৬০,০০০ একরের কাছাকাছি। যেসমস্ত ভূমি অস্থানীয়দের নিকট ইজারা প্রদান করা হয়েছে, তার অধিকাংশই শর্তানুযায়ী কাজে ব্যবহার করা হয়নি বা শর্ত পূরণের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে অথচ এখনও সেগুলো কোম্পানি বা সংস্থার নামেই রয়ে গেছে।
অনুরূপভাবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২৫ জুন ১৯৯০ থেকে ৩১ মে ১৯৯৮ তারিখে জারিকৃত বিভিন্ন গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাঙামাটি জেলার ২০টি মৌজার ৮৪,৫৪২.৪২ একর ভূমি এবং বান্দরবান জেলার ৭২,০০০ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের জন্য অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারই অংশ হিসেবে ব্রিটিশ কর্তৃক প্রণীত ১৯২৭ সালের বন আইন প্রয়োগ করে ভূমিগুলো অধিগ্রহণের কাজও চলমান রয়েছে।
এই বেহাত হওয়া ভূমি (অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ও বহিরাগত কর্তৃক দখল হওয়া ভূমি) পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে এবং পাহাড়িদের প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৪নং ধারাবলে একটি স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে স্মর্তব্য যে, ২০০১ সালে আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরোধিতা সত্ত্বেও একতরফাভাবে সরকার পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন ২০০১ প্রণয়ন করে। ফলে উক্ত আইনটিতে পার্বত্য চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক অনেক ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ১৫ বছর পরে ২০১৬ সালে এসে সরকার সেটি সংশোধন করে এবং চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি ভূমি কমিশন আইন পাশ করে।
এই আইনের ৬নং ধারার কমিশনের কার্যাবলি ও ক্ষমতা অনুচ্ছেদে ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি, নীতি ও পদ্ধতির কথা বলা আছে এবং কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্তে সরকারের যেকোনো সংস্থার কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত বা কাগজপত্র সরবরাহ এবং কোন কর্মকর্তাকে স্থানীয় তদন্ত, পরিদর্শন বা জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারিবে এবং ঐ কর্মকর্তা বা সংস্থা উহা পালনে বাধ্য থাকিবে’ মর্মে উল্লেখ করা আছে।
অনুরূপভাবে উক্ত আইনের ১৬ ও ১৭নং ধারাতে কমিশনের সিদ্ধান্তের আইনগত প্রকৃতি ও চূড়ান্ততা ও কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করে বলা আছে যে, “অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন,কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রি বলিয়া গণ্য হইবে এবং এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। এবং এই সিদ্ধান্ত কমিশন উহার কর্মকর্তা বা সরকারের যেকোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করিতে পারিবে এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সকল কর্তৃপক্ষ কমিশনের নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকিবে।”
একইভাবে ধারা ১৯ এবং ২০-এ “কমিশনের অবমাননা আদালত অবমাননার শামিল এবং কমিশন উহার অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবেন ও এই আইনের অধীন কৃত কার্যের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তজ্জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান বা কমিশনের অন্য কোনো সদস্য এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী কোনোপ্রকার আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না” বলে উল্লেখ করা আছে।
যেহেতু পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের সাথে কাগজপত্রের কোন সম্পর্ক নেই এবং স্মরণাতীতকাল থেকে তারা তাদের রীতি, নীতি, প্রথা, পদ্ধতির মাধ্যমেই ভূমি অধিকার ভোগ করে আসছে, সুতরাং এই কমিশনের ফলে পাহাড়িদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য এবং ভূমি সমস্যার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইনটি পাস হওয়ার ৭ বছরেও এখনও এর বিধি প্রণয়ন করা হয়নি। তাছাড়া কমিশন কাজ করতে গেলে তার জনবল, অর্থবল এবং পারিসম্পদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিধি প্রণয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি, নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরেও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ফলশ্রুতিতে ভূমি কমিশন আইন পাস হওয়ার পরেও এটি কার্যত অকার্যকর হয়েই পড়ে রয়েছে এবং ভূমি সমস্যার সমাধানের কাজে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।
অনুরূপভাবে ২০১৪ সালে স্থানীয় পর্যটন বিষয়টিও যথাযথভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন বা অন্য কোন সংস্থার দ্বারা পরিচালিত কোন দপ্তর ও পর্যটন কেন্দ্র পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত হয়নি। ফলে এখনও পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ এবং সেনাবাহিনী যত্রতত্র ভূমি দখল করে পর্যটন স্থাপন করে চলেছে। ২০১৪ সালে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ বাতিল করে পর্যটন বিষয়টির সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথাযথভাবে ও পূর্ণাঙ্গভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে হস্তান্তরের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে আঞ্চলিক পরিষদের বৈঠক হয় এবং উক্ত বিষয়াবলি যথাযথভাবে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু আজ অবধি তার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। অপরদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়াতে, এগুলো স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করতে পারেনি। ফলে পাহাড়িদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় না নিয়ে যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণ এবং পাহাড়িদের ভূমির যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পূনর্বাসন না করে, পাহাড়িদের মতের বিরুদ্ধে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। ফলে পাহাড়ে ভূমি সমস্যাটি দিন দিন জটিল থেকে জটিল আকার ধারণ করছে।
১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির “ক” খন্ডের ১নং ধারাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে এবং এর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। অতএব, উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংক্ষণের জন্য সমতল থেকে ১৯৭৯ সালের পরে পুনর্বাসিত সকল বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার যৌক্তিকতাও শেষ হয়ে যায়। এই লক্ষ্যেই পার্বত্য চুক্তিতে “স্থায়ী বাসিন্দা” শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। চুক্তির আলোকে গঠিত পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদের সমন্বয়ে যে স্বায়ত্বশাসিত আঞ্চলিক প্রশাসন, সেই প্রশাসন একটি জনকল্যাণমুখী এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল প্রশাসন হওয়ার কথা। সেই প্রশাসনকে যথাযথ ও আইনগতভাবে কার্যকর করে সমস্ত কার্যাবলি যথাযথভাবে হস্তান্তর করে পাহাড়ে শান্তি আনয়নের আরেকটি ধাপ অর্জিত হবে। কেননা পার্বত্য জেলা পরিষদের গঠন কাঠামোতে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বন্টন করা হয়েছে,একইভাবে আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষেত্রেও তাই।
পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রত্যেক সদস্যকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান রয়েছে এবং সেই ভোটাধিকার অর্জনের জন্য অন্যতম এবং গুরত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে পার্বত্য চুক্তির “খ(৯)”-এ “স্থায়ী বাসিন্দা” হতে হবে মর্মে শর্ত সংযোজন করা আছে। অপরদিকে অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞায় পার্বত্য চুক্তির “খ” খন্ডের ৩নং ধারায় লেখা আছে যে, “অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা বলিতে, যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণতঃ বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে।” এই উদ্দেশ্য সাধনকল্পে একই খন্ডের ৪(ঘ) তে উল্লেখ আছে যে, “কোন ব্যক্তি অউপজাতীয় কিনা এবং হইলে তিনি কোন সম্প্রদায়ের সদস্য তাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেট দাখিল সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের চীফ স্থির করিবেন।”
পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে অর্থাৎ জনগণের পরোক্ষ ভোটে আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন কেউ ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং নির্বাচনী প্রার্থী হতে পারবেন না। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এসে বসতিকারী কেউ ভোটাধিকার তথা রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারবেন না। তাছাড়া পার্বত্য জেলার সমস্ত চাকরিতে স্থায়ী আদিবাসী তথা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পাহাড়িদের নিয়োগের বিধান রয়েছে। যেহেতু বহিরাগত সেটেলারদের “স্থায়ী বাসিন্দা সনদ” ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক প্রদত্ত এবং পার্বত্য চুক্তিতে এই সনদ প্রদানের এখতিয়ার কেবল সার্কেল চীফের রয়েছে সুতরাং আইনানুসারে ডিসি প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেটগুলোর কোন বৈধতাই থাকে না এবং থাকতে পারে না।
কিন্তু ২০০০ সালে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের জারীকৃত এক আদেশের মাধ্যমে সার্কেল চীফের পাশাপাশি ডেপুটি কমিশনারকেও স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদানের এখতিয়ার দেওয়া হয়। যা সরাসরি পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন। এছাড়া “চার্টাজ অব ডিউটিজ অব ডেপুটি কমিশনারস্” পরিপত্রে ডেপুটি কমিশনারদের নাগরিকত্ব সনদ প্রদানের বিধান থাকলেও স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদানের কোন বিধান নেই। ফলশ্রুতিতে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এখানে তাদের থাকার কোন আইনী যৌক্তিকতাও আর থাকে না। কিন্তু পার্বত্য জেলার ডিসিগণ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের উক্ত আদেশবলে প্রতিনিয়ত বহিরাগতদের স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র প্রদান করেছে। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনও পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা সনদের ক্ষেত্রে “ডেপুটি কমিশনার বা সার্কেল চীফ” প্রদত্ত উভয় সার্টিফিকেটেরই বৈধতা দিচ্ছে। ফলস্বরূপ ডিসি প্রদত্ত সনদকে ব্যবহার করে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের ন্যায় নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। বিশেষ করে শিক্ষা, চাকরি এবং ভূমির মালিকানা অর্জনে তারা এই সার্টিফিকেটকে ব্যবহার করছে, যা সম্পূর্ণ আইনের পরিপন্থী এবং পার্বত্য চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।
এছাড়া চুক্তির ২৫টি বসন্ত অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও পাহাড়ে কার্যত এখনও আইনের সুশাসন তথা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন না হওয়াতে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। ফলে পাহাড়ে এখনও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক শাসনকাঠামো গড়ে উঠতে পারে নি। উল্টোভাবে ২০১৪ সালে পার্বত্য জেলার অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে এই পরিষদসমূহকে আরো বেশি করে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে।
অপরদিকে ২০০১ সাল থেকে অপারেশন উত্তরণের নাম দিয়ে কার্যত সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত সাধারণ ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যার দরুণ পাহাড়ে কোন কালভার্ট করতে গেলেও সেনা প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অথচ পার্বত্য চুক্তির “ঘ” খন্ডের ১৭ নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত অস্থায়ী সেনাক্যাম্পসহ আনসার ও ভিডিপির ক্যাম্পসমূহ পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়ার বিধান রয়েছে এবং একইভাবে উক্ত জায়গা-জমিগুলো প্রকৃত মালিকদের নিকট হস্তান্তর বা জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের বিধান রয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আঞ্চলিক পরিষদের অনুরোধক্রমেই সেনাবাহিনীকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান সংযুক্ত রয়েছে।
তাছাড়া আইন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলার সংরক্ষণ, তত্ত্বাবধান ও উন্নয়নের সাধনের দায়িত্ব পার্বত্য জেলা পরিষদের হাতে থাকলেও আজ অবধি সংশ্লিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষই তা অনুসরণ করেনি। অনুরূপভাবে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা ও উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এখনো কার্যকর করা হয়নি। অপরদিকে সেনা-পুলিশ কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুসরণ করেই তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করে চলেছে এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনের নাম করে পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর একছত্র আধিপত্য চলমান রয়েছে, এর অর্থ এটাই যে পাহাড়ে সেনাশাসন চলমান।
অপরদিকে চুক্তিতে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান থাকলেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক সেনাক্যাম্প থেকে মাত্র ১০১টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং এরপর থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অধিকিন্তু ২০১৯ সালে করোনা মহামারিতে আরো ৩০টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া চুক্তির আলোকে সেনাক্যাম্পগুলো প্রত্যাহারের জন্যেও এখনও পর্যন্ত কোন সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নি।
উপরোক্ত বিষয়গুলো অবতারণা করার উদ্দেশ্য এই যে, বহিরাগত সেটেলার ও সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার কোন যৌক্তিকতা যেমন নেই, তেমনিভাবে আইনগত কোন ভিত্তিও নেই। ভূমি কমিশনের ফলে বহিরাগতরা পার্বত্য এলাকার ভূমির মালিক হতে পারে না এবং এই বহিরাগতরা পার্বত্য এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়াতে কোনোপ্রকার ভোটাধিকার তথা রাজনৈতিক অধিকার এবং চাকরির সহ নানাধরনের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকার রাখে না। অপরদিকে পাবত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে উপজাতীয় এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার রয়েছে, যার ফলে বহিরাগতরা কোন চাকরি কিংবা পেশার সুযোগ পাবে না। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের থাকার কোন বাস্তবতাও তৈরি হবে না এবং হওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেবলমাত্র সরকারি রেশনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করা তাদের জন্য দূরূহ হয়ে পড়বে। এইভাবে যেহেতু বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার কোন পরিবেশ থাকবে না,সুতরাং তাদের রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে সেনাবাহিনীরও পাহাড়ে থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
অপরদিকে পাহাড়ের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা হওয়া সত্বেও দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলারা এটিকে নাকচ করে বরাবরই এটিকে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় রাখে। ফলস্বরুপ তারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিপরীতে অধিকতর সামরিকায়ন, বহিরাগতের অনুপ্রবেশকরণ এবং পরিবেশ ও জনসংস্কৃতি বিধ্বংসী অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর এই সামরিকায়ন,বহিরাগতের অনুপ্রবেশ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমি বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পাহাড়ের এই সমস্যাকে জিইয়ে রাখতেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী তথা সেনা-আমলাতন্ত্র বহিরাগতদের পাহাড়ে বৈধতা দিতে চায়। সেনাবাহিনী যেমন এই বহিরাগতদেরকেই মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, একইভাবে তারাই আবার এই বহিরাগতদের রক্ষাকর্তা (সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে)। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামীকরণের উদ্দেশ্য নিয়েই যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র অগ্রসরমান, সেকারণেই ইউএনডিপি এবং ইইউ-এর মত বহু বৈদেশিক সংস্থা কর্তৃক অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া সত্বেও রাষ্ট্র এই বহিরাগতদের সমতলে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের কোন উদ্যোগ হাতে নেয়নি এবং নিচ্ছেও না। যেহেতু বহিরাগতদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসন করা হচ্ছে না,সুতরাং পাহাড়ে সেনাবাহিনীকে থাকতেই হবে। কেননা বহিরাগত এবং সেনাবাহিনী একে-অপরের পরিপূরক।
এই লক্ষ্যে সেনাবাহিনী পাহাড়ে নিজেদের অবস্থানকে বৈধতা দেওয়ার বৃথা প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে এবং পাহাড়কে অশান্ত করার একের পর এক নীল-নকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন দল-উপদল সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং সন্ত্রাস নির্মূলের অজুহাত দেখিয়ে যত্রতত্র সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ করে নিজেদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে চলেছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হতে না হতেই ইউপিডিএফ নামধারী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়। এরপর যথাক্রমে জরুরী অবস্থার সময়ে (২০০৭-২০০৮) সংস্কারপন্থী জেএসএস, তারপর বিদেশী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি) যাদেরকে পরে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক-মুহূর্তে নামকরণ করা হয় মগপার্টি, ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের শেষান্তে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (যা বম পার্টি নামে সমধিক পরিচিত) প্রভৃতি সংগঠনকে জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়। সেনাবাহিনী তাদেরই সৃষ্ট এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লেলিয়ে দেয়, পক্ষান্তরে আবার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য অপপ্রচার চালানো হয় এবং তার দায় চাপানো হয় জনসংহতি সমিতি ও অধিকার আদায়ের সোচ্চার সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর।
বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত ও প্রচলিত বিষয় পাহাড়ে সন্ত্রাস। রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে শুরু করে আমলা-পুঁজিপতি সকলেই এখন পাহাড়ে সন্ত্রাসের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। চুক্তির ২৫ বছরে এসে এখন পাহাড়ে স্থায়ী সমাধানের বিপরীতে পাহাড়কে আবারো অশান্তকরণের প্রক্রিয়াই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, সন্ত্রাসের সংজ্ঞাটাই আসলে কি? ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের পক্ষ হতে জনসংহতি সমিতি এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে উপনীত হলো। অথচ সেই চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকেই সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যয়িত করার রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মদদে সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। সত্যি বলতে পাহাড়ে শান্তি এখন কল্পনার চেয়েও বহুদূরে চলে গেছে। শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে উড়ানো শ্বেতকপোতগুলো অনেক আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির পালে নগ্নতা আর উচ্ছৃঙ্খলতার হাওয়া লেগেছে। সেই হাওয়ার তালে পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন আরো সংঘাতময়, আরো নগ্ন এবং আরো ভয়ংকর রূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। শান্তির প্রত্যাশা আর স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৭ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, আজ সেই চুক্তিকে প্রতি পদে পদে ভূলন্ঠিত করে একের পর এক তালবাহানা চলছেই। একদিকে চুক্তি-পূর্বের ন্যায় অপারেশন দাবানলের স্থলে অপারেশন উত্তরনের নামে সামরিক শাসন, অপরদিকে কর্পোরেট কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান দিয়ে নয়া উপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণ এবং জাতীয় বিভাজনের নীতিকে ধরে অগ্রসরমান শাসকশ্রেণি, এই সব মিলিয়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন আর শান্তির কথা বলে না। রাষ্ট্রীয় সেবায় নিযুক্ত কেউই এখন আর পাহাড়ে শান্তি আনয়নের কথা বলে না। পাহাড়ে শান্তি এখন চিরশান্তির নিদ্রায় মগ্ন। প্রকৃতপক্ষে পাহাড়িদের নিকট রাজনৈতিক অধিকার হস্তান্তর ব্যতিরেকে অর্থাৎ পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে পাহাড়ে শান্তির কল্পনা অলৌকিক এক দিবাস্বপ্ন মাত্র।