হিল ভয়েস, ১০ আগষ্ট ২০২২, ঢাকা: আমাদের আাদিবাসী সমাজে নারীর জীবন চক্র চলে আতুরঘরে, শয়ন ঘরে ও রান্নাঘরে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবদান যাই হোক না কেন, সেটা স্বীকৃতি লাভ করেনি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা।
‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আজ বুধবার (১০ জুলাই) ঢাকার ডেইলি স্টার ভবনের এ. এস. মাহমুদ সেমিনার কক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আয়োজনে এই সেমিনারটি আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং-এর সভাপতিত্বে এবং সংগঠনটির সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা’র সঞ্চালনায় উক্ত সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফেরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি বাসন্তী মুর্মু প্রমুখ। উক্ত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য চন্দ্রা ত্রিপুরা।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সন্তু লারমা আরো বলেন, ‘জাতিসংঘ থেকে মূল প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া হয়েছে সেখানে নারীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সারা বিশ্বে নারীকে বাদ দিয়ে সমাজ সংস্কৃতির কোনো কিছুই ভাবা যায় না। নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের অগ্রগতি কল্পনাতীত। সমাজে নারীর অবস্থান আসলেই সম্মানজনক নয়। আমাদের সমাজ শ্রেণি বিভক্ত, যেখানে সমাজ ব্যবস্থা বৈষম্যমুক্ত নয়। জাতিভেদ, লিঙ্গ ভেদ, বর্ণ ভেদ কত রকমের ভেদাভেদ রয়েছে। এখানে নারী হিসাবে ও আদিবাসী হিসেবে আদিবাসী নারীরা সমাজে দ্বিগুণ প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। শাসনতান্ত্রিক পর্যায়েও নারী ও পুরুষ দুটোই অবস্থান করে। কিন্তু সেখানে নারীকে সেভাবে সম্মান দেওয়া হয় না।’
সরকার আদিবাসী শব্দ নিয়ে পুরো তার প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। কাজেই সরকার এক্ষেত্রে গণবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, প্রগতি বিরোধী বলেও তিনি মনে অভিমত ব্যক্ত করেন। কাজেই এমন অবস্থায় নারীরা ভালো থাকতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের কোনো আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নেই। সামাজিক জীবন হোক বা রাষ্ট্রীয় জীবন হোক কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে সম্মান দেয়া হয় না। তাই ঐতিহাসিক কাল ধরে নারীর যে অবদান সেটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কাজেই সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীদেরকে সংগ্রামী হতে হবে এবং অধিকার সচেতন হয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে।’ যেখানে পুরুষদেরকেও যুক্ত হতে হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন এই আদিবাসী নেতা।
তিনি আরো বলেন, ‘আজকে যারা সরকারে আছে, তারা কখনো দেশের সংখ্যাগরিষ্ট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে না। তারা করছে নিজেদের দলের এবং ধনিক শ্রেণির। যাদের অর্থ আছে তারাই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আর সরকার গঠন করছে। কাজেই তারা খুবই সংখ্যালঘু শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু সমাজে গরীব, নিরীহ ও মেহনতী মানুষের সংখ্যা বেশি যাদের প্রতিনিধিত্ব সরকারে নেই। কাজেই আমাদেরকে এমন লড়াই ও রাজনীতি নির্ধারণ করতে হবে, যে রাজনীতি আদিবাসী নারীকে সম্মান দিবে, অধিকারের স্বীকৃতি দিবে। কাজেই আমাদেরকে এমন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে।’
প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সমালোচনা করে সন্তু লারমা আরো বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো হাজার হাজার মানুষ রয়েছে যারা এখনো বাংলা বলতে পারে না, বাংলা বুঝে না।’ তাহলে তারা কীভাবে মূলধারার বাঙালি সমাজের সাথে প্রতিযোগিতা করে চাকরি লাভ করবে বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেখানে নারী-পুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করেছিল। দেশের আদিবাসী নারী-পুরুষরাও নিজেদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ নিয়ে বিকশিত হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু এযাবৎ পর্যন্ত উন্নয়নের নামে, পর্যটনের নামে যেভাবে আদিবাসীদেরকে নানাভাবে প্রান্তিক করা হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। জাতিসংঘ এবার যে নারীদের বিষযটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। আদিবাসীরা নিজেদের প্রকৃতির সন্তান হিসাবে দাবি করে, যেখানে নারীরাই অবিচ্ছেদ্য অংশ। আদিবাসী নারীরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বন, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের বিজ্ঞান ভিত্তিক ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানের মাধ্যমে রক্ষা করে আসছে। এই জ্ঞানকে রাষ্ট্র কখনো স্বীকার করেনি।’ আদিবাসী নারীদের এই ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই নারী নেত্রী।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘আদিবাসী নারীরা জলধারা, বন ও প্রজন্ম পরম্পরা নিজেদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানগুলো রক্ষা করে আসছেন। আমরা যদি অকৃত্রিম ভালোবাসা পেতে চাই, নির্ভেজাল জীবন পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে আদিবাসী নারী সমাজের কাছে ফিরে যেতে হবে। আদিবাসীদেরকে নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্ববোধ প্রতিদিন গ্রাস করছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে কিন্তু শুধুমাত্র বাঙালির কথা লেখা নেই, লেখা ছিল ‘বাংলাদেশের জনগণের’ মুক্তির কথা। কাজেই সেক্ষেত্রে বাঙালি ছাড়াও চাকমা, মারমা, গারো, সান্তাল সবার মুক্তির কথা বলা হয়েছে। আমরা সেটা নিশ্চিত করতে পারিনি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশে যে কম পরিমাণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে, তাদের যদি মুক্তি না ঘটে তাহলে পুরো বাংলাদেশের মুক্তি হবে না। এছাড়া নারী মুক্ত না হলে পুরুষও মুক্তি পাবে না। আমরা নারীর স্বীকৃতি নানান জায়গায় দিইনি। আমরা এখনো নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলিনি, বলি বীরাঙ্গনা। পুরুষতন্ত্র নারীর উঠাবসা, পোষাক পরা সবকিছুকেই নির্মাণ করে দিয়েছে। নারীরা সবখানেই পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির শিকার।’ এছাড়া পুরুষতন্ত্র ও মৌলতন্ত্রের যুক্ত চ্যালেঞ্জ নারীকে আরো অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে বলেও মনে করেন।
লাকিংমে চাকমা অপহরণের প্রসঙ্গ এনে তিনি আরো বলেন, ‘লাকিংমে ১৩ বছরের এক আদিবাসী নারী। যাকে এক বাঙালি দ্বারা অপহরণ করা হয়েছে। তাকে ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়েছে, জোর করে বিবাহ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাহলে তাকে প্রতি রাতেই ধর্ষণ করা হয়েছে। তারপর তাকে হত্য করা হয়েছে এবং তার লাশ অনেক দিন পড়ে ছিল হাসপাতালের লাশ ঘরে। কাজেই তার উপর ধর্মীয়, জাতিগত, পুরুষতান্ত্রিক সব ধরনের নিপীড়ন করা হয়েছে। এটাই বাংলাদেশে আদিবাসী নারীর চিত্র।’
বাংলাদেশ আদিবাসী ফেরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘আদিবাসী নারীর অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। এটা আমাদের সবাইকে মানতে হবে। আমরা বলি ‘মাদার আর্থ।’ ‘ফাদার আর্থ’ বলি না। কাজেই দেখেন আমাদের নারীরা কত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যাদের কোলে ভাষা শিখেছি সেটা হলো মা। এছাড়া আদিবাসী নারীরা অনেক খাদ্য দ্রব্যের আবিষ্কারক। সাধারণ বাঙালি সমাজের সাহিত্য বলে পুরুষ নারীকে রক্ষা করে। কিন্তু আদিবাসী সমাজে আমি যেটা দেখেছি আদিবাসী নারীরাই পুরুষদেরকে রক্ষা করে। যেদিন আমরা আদিবাসী নারীকে সম্মান করবো, সেদিনই কেবল এই পৃথিবী আরো সুন্দর হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘জাতিসংঘের মতে আদিবাসী নারীরা পাঁচ স্তরের বৈষ্যমের শিকার হয়। প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী নারী হিসাবে, তৃতীয়ত দরিদ্র নারী হিসাবে, চতুর্থত পাহাড়ের প্রান্তিক জায়গায় বসবাসের কারণে, পঞ্চমত বন-ভূমি-পাহাড় থেকে উচ্ছেদের শিকার হওয়ার কারণে।’
আদিবাসী নারী পরিষদের সভাপতি বাসন্তী মুর্মু বলেন, ‘আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নারীরা তার পরিবারে, সমাজে তার কতটুকু অধিকার তা নিজেরাই জানে না। নারীরা যে সন্তান জন্ম দেয়, লালন পালন করে, গ্রামে-গঞ্জের নারীরা মনে করে এটাই কেবল নারীর কাজ এবং এটাতেই শেষ। আমাদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে, নারীর কাজ কেবল সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন করা হয়।’ আদিবাসী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৃণমূল পর্যায়ের কাজগুলোতে আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, ‘আদিবাসীদের স্বকীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন, মাতৃভাষা ও নিজেদের ঐতিহ্যগত পোষাক-পরিচ্ছদ সংরক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে নারী সমাজের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। আদিবাসী শিশুরা মায়ের কাছ থেকেই মাতৃভাষা শিখতে শুরু করে এবং এক্ষেত্রে মায়েরাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও আদিবাসী পোষাক-পরিচ্ছদ সংরক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে আদিবাসী নারীদের একচেটিয়া অবদান। জুমে তুলা উৎপাদনের পর তুলাকে সুতায় রূপান্তর করা, সুতার রঙ করা এবং বুননের নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিধানযোগ্য নানা পোষাকের উৎপাদন নারীরাই করে থাকে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে আদিবাসীদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, জীবনযাত্রা, খাদ্য ও জননিরাপত্তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ভূমি দখল, হত্যা, জাতিগত নিপীড়ন ও নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে এবং সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে এক অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে যা আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে ব্যাঘাত ঘটছে। সরকারের সদিচ্ছা ও ইতিবাচক আচরণই এসব বাধাগুলো থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।’
উক্ত প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, আদিবাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান, জলের সহজলভ্যতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য আদিবাসী অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করাসহ ৬ টি সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি।
এছাড়াও সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচী পরিচালক বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য রাখী ম্রং, খাগড়াপুর মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক শেফালিকা ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী হেডম্যান কার্বারী নেটওয়ার্কের সভাপতি জয়া ত্রিপুরা, সমতলের আদিবাসী নারী নেত্রী হৈমন্তী সরকার, অনন্যা দ্রং প্রমুখ।