মঙ্গল কুমার চাকমা
সম্প্রতি আগষ্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তাঁর সফরে ব্যাচেলেট অন্যান্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন ২০০৯ সাল থেকে দেশে গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার বিষয়টি। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং পার্বত্যাঞ্চলের স্বাধীন পক্ষগুলোর জন্য অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিও তিনি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছিলেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করে জাতিসংঘ নির্যাতন বিরোধী কমিটিসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, দমন-পীড়নের অভিযোগ করে আসছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জন গুম হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০ বছর ধরে অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখা ৮৬ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে।
মিশেল ব্যাচেলেট তাঁর সফরের শেষান্তে ১৭ আগষ্ট ২০২২ ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তাই তিনি এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কার্যকর অন্তর্ভুক্তি, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছেন তিনি। বিশেষ করে গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য তিনি সরকারকে একটি স্বাধীন ও বিশেষায়িত কর্মব্যবস্থা (মেকানিজম) প্রবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করে সেধরনের একটি স্বাধীন সংস্থা কীভাবে গঠন করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানে জাতিসংঘের দপ্তর তৈরি আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
এখন দেখার বিষয় সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারের সুপারিশ কীভাবে ও কী পরিমাণে বিবেচনায় নিয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে সরকার কখনোই দায় এড়াতে পারবে না। সরকার যদি ব্যাচেলেটের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসে তা নি:সন্দেহে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনে আশার সঞ্চার করবে।
দেশের গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে তথা অধিকারকামী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক অপরাধীকরণ (ক্রিমিনালাইজেশন)-এর পদ্ধতিগত প্রক্রিয়াও একই সূত্রে গাঁথা। এ বিষয়টাকে কোনোক্রমেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসী জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে তকমা দিয়ে অব্যাহতভাবে অপরাধীকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে জুম্ম জনগণের ঘরবাড়ি তল্লাসী, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের, আদালতে সোপর্দ না করে দিনের পর দিন ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সেই সাথে ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ, জুম্ম নারীর প্রতি সহিংসতা, বহিরাগত অনুপ্রবেশ, সাম্প্রদায়িক হামলা ও জুম্ম গ্রামে অগ্নিসংযোগ, চুক্তি বিরোধী অপপ্রচার ইত্যাদি জুম্ম স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমও আজ জোরালোভাবে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পর তৎকালীন সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো সরকারই চুক্তি বাস্তবায়নে আশানুরূপভাবে এগিয়ে আসেনি। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার বর্তমানে ২০০৯ সাল থেকে একনাগাড়ে প্রায় ১৪ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি।
ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা; নির্বাচন বিধিমালা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন পূর্বক আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’ ও সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখল হওয়া জায়গা-জমি জুম্মদের নিকট ফেরত দেয়া এবং এলক্ষ্যে ভূমি কমিশনের বিধি প্রণয়ন করা; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক যথাযথ পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিল করা; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন, ১৯২৭ সালের বন আইন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন প্রদান করা ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে তো আসেইনি, অধিকন্তু পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করে। এই ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের নীতি অনুসরণ করে চলেছে। চুক্তি মোতাবেক সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পরিবর্তে বর্তমানে প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গাগুলোকে পুনরায় ক্যাম্প পুন:স্থাপন করা হচ্ছে। কেবল কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ২০টির অধিক সেনা ক্যাম্প পুন:স্থাপন করা হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ এবং জেলার আইন-শৃঙ্খলার তত্ত্বাবধান ও উন্নয়ন” বিষয় দু’টি ন্যস্ত না করে এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিষদের আইন ও বিধি মোতাবেক ‘পার্বত্য পুলিশ বাহিনী’ গঠন না করে সরকার সম্প্রতি প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গাগুলোতে এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।
সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের উপর অঘোষিত সেন্সরসীপ আরোপ করেছে। বিশেষ করে নাগরিক অধিকারের সংকোচন, জোরালো নজরদারী, হয়রানি ও নির্যাতন চলমান থাকায় মতপ্রকাশে ও সংবাদ প্রকাশে স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ (সেন্সরসীপ) কাজ করে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর প্রকাশে দেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো সুকৌশলে এড়িয়ে চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অনেক নিউজপোর্টাল বন্ধও সরকার করে দিয়েছে। অপরদিকে ২০১৫ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর সুপারিশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর ১১টি বিধি-নিষেধ জারি করে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিদেশীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া এবং দেশি-বিদেশী সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জুম্মদের সাথে কথাবার্তা বলার সময় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি রাখা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা। এভাবে আজ কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করা হয়েছে অবরুদ্ধ অঞ্চলে।
এমনিতর পরিস্থিতিতে ১৭ আগষ্টের সংবাদ সম্মেলনের বক্তৃতায় জাতিসংঘের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট হিন্দু সম্প্রদায়সহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসমূহকে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেছেন, ২৫ বছর আগে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ ও বেসামরিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাচেলেট পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও স্বাধীন পক্ষসমূহের ওই এলাকা পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে অবাধ অনুমতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।
দেশে গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যার বিষয়টির মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার পূর্বক এলাকাটি বেসামরিকীকরণ, সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে বিদেশীদের বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ নেয় কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধানের সুপারিশ কতটুকু আমলে নেয় তা দেখার বিষয়।
তবে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের বক্তব্য ও হাবভাব দেখে সরকার এ বিষয়ে সবিশেষ এগিয়ে আসবে এমনটা আশা করা খুবই কঠিন ব্যাপার। সরকার এখনো সেই চর্বিত চর্বনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। মিশেল ব্যাচেলেটকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে যেভাবে ব্রিফ করেছেন বলে সাংবাদিক বলেছেন তাতে নিশ্চিত যে, চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে মর্মে সরকার এখনো সেই শিবের গীত গেয়ে চলেছেন। আর মানবাধিকার হাইকমিশনারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শনে অনুমতি না দেয়ার ফলে ইতিমধ্যে জাতিসংঘে নি:সন্দেহে একটি নেতিবাচক ধারণা জন্ম দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি যদি অসত্য হতো, তাহলে ব্যাচেলেটকে পার্বত্যাঞ্চল সফরে অনুমতি না দেয়ার কোন কারণ ছিল না।
তবে আমরা যারা পার্বত্য সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই, আমরা সকলেই কামনা করি এবং আশাবাদ জিইয়ে রাখতে চাই যে, সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ক্রমাগত ১৪ বছরের দীর্ঘমেয়াদকালেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতা ও গড়িমসির দায় সরকার এড়াতে পারবে না। এ নিয়ে সরকারের উপর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ দেশে-বিদেশে প্রবল ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে যদি সরকার জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের সুপারিশ আমলে নিয়ে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে, তা নি:সন্দেহে বর্তমান সরকার তথা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। অন্যথায় বর্তমান সরকারের আমলে দেশে অব্যাহত গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং বিচারহীনতার বিষয়টি যেভাবে একটি বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, সেভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে আরো জোরালো হয়ে উঠবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং সামরিকায়ন ও সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়টি কেবল এবারের জাতিসংঘ মাবনবাধিকার হাইকমিশনারের তদন্তে উঠে এসেছে, তা নয়। এর পূর্বে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধীন আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম, মানবাধিকার পরিষদের অধীন ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর), বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সহ জাতিসংঘের বিভিন্ন ট্রিটি কমিটির সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুটি উঠে এসেছে।
গুম ও বিচাব-বহির্ভূত হত্যার জবাবদিহিতার জন্য একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার যে সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেছেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, বেসামরিকীকরণ ও পার্বত্যাঞ্চলের উপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের সহযোগিতার বিষয়টি এধরনের প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যকার চুক্তি, ইতিবাচক পদক্ষেপ ও সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের একটা বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে।
যেমন জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের রেজোলিউশন ৩৩/২৫-এর অনুসারে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কর্মব্যবস্থা (এক্সপার্ট মেকানিজম) অনুরোধক্রমে সদস্য রাষ্ট্র এবং/অথবা আদিবাসীদের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করতে কারিগরী সহায়তা প্রদান করে থাকে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এক্সপার্ট মেকানিজম ২০১৮ সালে ফিনল্যান্ড ও মেক্সিকো, ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০২০ সালে সুইডেন ও ব্রাজিল এ ধরনের মিশন পরিচালনা করেছে। তাই সরকার আন্তরিক হলে মানবাধিকার পরিষদের অধীন এক্সপার্ট মেকানিজমের এই বিশেষ প্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারে।
জানা গেছে, মিস ব্যাচেলেট তাঁর মেয়াদ শেষ করার আগে আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সভায় বক্তৃতা দেবেন। বাংলাদেশের জন্য সেটাও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা দরকার বলে মনে করি। ব্যাচেলেটের সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে জানা গেছে যে, জলবায়ু ও মানবাধিকার বিষয়ক নতুন স্পেশাল র্যাপোর্টিয়র শিঘ্রই বাংলাদেশ পরিদর্শনে আসছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও সেসংক্রান্ত মানবাধিকারের সাথে আদিবাসী ইস্যুটি ওত:প্রোতভাবে জড়িত। তাই ব্যাচেলেটের সুপারিশ অনুসারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নসহ আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংসতা ও তাদের ভূমি বেদখল থেকে সুরক্ষার বিষয়টিও সরকারকে আমলে নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী বলে বিবেচনা করা যায়।
এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, দেশে গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বেসামরিকীকরণ তথা পার্বত্যাঞ্চলে ভ্রমণের উপর বিধি-নিষেধের ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠে এসেছে সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ অস্বীকার না করে বরং গুরুত্ব দিয়েএ অভিযোগ বিবেচনা করা অপরিহার্য। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প এবং ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন অচিরেই প্রত্যাহার করার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে, যেটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির কয়েকটি সভায়ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী তথা দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই তা অত্যাবশ্যক। তা না হলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।
জাতিসংঘের হাইকমিশনারের ঢাকা সফরের প্রাক-মুহূর্তে ১০ আগষ্ট হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ৯টি সংগঠনের বিবৃতিতেও আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের চলমান ঘটনার কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনা সদস্যদের মোতায়েনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সময়ে আবার ৬টি প্রবাসী জুম্ম সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ সাময়িক বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রম বিষয়ক দপ্তর এবং মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিসকে আহ্বান জানিয়েছে। ৬টি প্রবাসী জুম্ম জনগণের এই প্রতিবেদনেও একটা তাৎপর্য রয়েছে বলে বলা যেতে পারে।
এ সময় একটি মানবাধিকার প্রতিনিধিদল জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের অফিসে গিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্যাঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছিলেন। তারা সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক পর্যটন এবং ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল ও জুম্মদের উচ্ছেদ, ভূমি বেদখলের উদ্দেশ্যে জুম্মদের ঘরবাড়ি ও বাগান-বাগিচায় অগ্নিসংযোগে সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের উস্কানী ও মদদ প্রদান, সেটেলার ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা প্রদান, জুম্ম অধিকার কর্মীদেরকে অপরাধীকরণ, সাজানো মামলা দায়ের, অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ও জিনিষপত্র তছনছ, জুম্ম নারী ও শিশুর উপর সহিংসতা ইত্যাদির উপর সম্প্রতি সংঘটিত সুনির্দিষ্ট ঘটনাবলী উদাহরণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী তুলে ধরেছিলেন। কাজেই সময় থাকতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন এবং চুক্তি মোতাবেক বেসামরিকীকরণ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকরকরণ ইত্যাদি বিষয়ে আর গড়িমসি না করে অনতিবিলম্বে সরকার এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা আপামর দেশবাসীর।