হিল ভয়েস, ৯ আগষ্ট ২০২২, ঢাকা: আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কাপেং ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের আদিবাসী জনগণের সামগ্রিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। ভূমি বেদখল, হামলা, বসতভিটা জ্বালিয়ে দেয়া, আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ এবং হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা প্রভৃতি সংঘটিত হচ্ছে। সেকারণে আদিবাসীদের মানবাধিকারের অবস্থা নাজুক হচ্ছে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, শ্লীলতাহানির চেষ্টা যৌন হয়রানীসহ আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতার কমপক্ষে ১২ টি ঘটনা যার মধ্যে ৭টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং ৫টি সমতল এলাকার আদিবাসী নারী, শিশু ও মানসিক প্রতিবন্ধিও এসকল ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন । এগুলোর মধ্যে ১ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে দলগত ধর্ষণ, ২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা, ৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা, ২ জনকে হত্যার চেষ্টা এবং আরো ২ জনকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হয়েছে। এসকল ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশী মর্মান্তিক ও নৃশংস ছিল বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় এক জুম্ম নারীকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।
অন্যদিকে ভূমি বেদখল অথবা দখলের চেষ্টা, আবাদী ফসল নষ্ট করে দেওয়া, বাধা, হত্যার হুমকি ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ সংক্রান্ত ২১ টি ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চিরায়ত ভূমি বেদখলের ঘটনার সংখ্যা ২ টি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৮৯১ একরের মত জমি বাঙালি সেটলার, নিরাপত্তাবাহিনী অথবা ভূমিদস্যু কর্তৃক দখল করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ৪৪ টি পরিবার এবং ৪ জন্য ব্যক্তির অন্তত ২৩ একর জমি দখল করে নেওয়া হয়েছে। এগুলো ছাড়াও প্রায় ৩৯ টির মত ঘটনা ঘটেছে যেগুলোতে আদিবাসীদের আবাদী ফসল নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ২ জন আদিবাসী কৃষককে তাদের জমিতে কাজ করতে বাঁধা দেওয়া হয়েছে, ১ জনকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ৭১ টি আদিবাসী পরিবার ভূমি থেকে উচ্ছেদের হুমকিতে রয়েছে।
বান্দরবানের আলিকদম উপজেলার মাতামুহুরি রিজার্ভ ফরেস্টের বিভিন্ন ঝিরি-ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলনের মত ঘটনাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতিবছর সংরক্ষিত এলাকা থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন করা হলেও প্রশাসনের কাছে ঐ পাথর উত্তোলনকারীদের কোন তথ্য নেই। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত পাথর উত্তোলনের কারণে ঝিরি-ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে কৃষি কাজে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ে বসবাস করা ম্রো, ত্রিপুরা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা প্রভৃতি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী সুপেয় পানির অভাবে ভুগছে।
অন্যদিকে আদিবাসীদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, হামলা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও আটক, তল্লাশি ও ভাঙচুর, হত্যা, মারধর ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাসহ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত মোট ৩৮ টি ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে বাঙালি সেটলার কর্তৃক ৪৬ টি আদিবাসী বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ১৬ জন আদিবাসী নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ১৩ টি বাড়ি তল্লাশি ও ভাঙচুর করা হয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনী দ্বারা ১৪ জনকে নির্যাতন করা হয়েছে, ১৪ জনকে অবৈধভাবে আটক করা হয়েছে, ৩ জনকে হত্যা ও ২ জন আক্রমণ শিকার হয়েছে, ৩ জন বাঙালি সেটলার কর্তৃক মারধর করা হয়েছে। এছাড়াও বান্দরবানের থানচি এবং আলিকদম উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৬০ জনের অধিক ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয় যেখানে ১ জন শিশুসহ মোট ১০ জন রোগীর মৃত্যু হয়।
মোটকথা, প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করা, ন্যায়বিচার না পাওয়া, মিডিয়া এবং মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল ধারাগুলোর অবাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২২ উপলক্ষে কাপেং ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সরকারকে আদিবাসীদের মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রচারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণসহ ভূমি ও প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, আদিবাসী অধিকার কর্মীদের মিথ্যে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশনসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ ও যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানিয়েছে কাপেং ফাউন্ডেশন।