হিল ভয়েস, ১ জুলাই ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম ত্রিপুরা পাড়ায় গুলি বর্ষণ এবং ৩ জন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে গুলিবিদ্ধ করার পর সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গী মদদপুষ্ট বমপার্টি নামে খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবার বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়ন এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলাধীন বিভিন্ন তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা পাড়া উচ্ছেদে নেমেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, কেএনএফের সন্ত্রাসীরা এখন রেইংখ্যং ভ্যালীর বড়থলি ইউনিয়ন ও রোয়াংছড়ির বিভিন্ন তঞ্চঙ্গ্যা পাড়াসমূহে সশস্ত্র অবস্থায় গিয়ে তঞ্চঙ্গ্যাদেরকে গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে চলেছে।
বম পার্টির সন্ত্রাসীদের হুমকির ফলে গত বুধবার (২৯ জুন) বড়থলি ইউনিয়নের বিলপাড়ার ২২টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার গ্রাম ত্যাগ করেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
একইদিন (২৯ জুন) সকালে কুকি-চিন পার্টির ৭ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের প্রভাতচন্দ্র কার্বারী পাড়ায় (থাংপুরী পাড়া) গিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীদেরকে গ্রাম ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। ফলে উক্ত গ্রামের ৬টি পরিবারের মধ্যে ৫টি পরিবার রোয়াংছড়ি সদরে এবং বাকি ১টি পরিবার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের শঙ্খমণি পাড়াতে চলে গেছে।
এর আগে গত ২৬-২৭ জুন বড়থলি ইউনিয়নের মিটিঙ্গ্যাছড়ির ৭টি ত্রিপুরা পরিবার এবং হেইঙ্গ্যোছড়ার ৮টি তঞ্চঙ্গ্যা পরিবার গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক গ্রামবাসী জানান, কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা দীর্ঘদিন ধরে হুমকি দিয়ে আসছে যে, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার ৯টি উপজেলাকে নিয়ে তাদের (বমপার্টির) কল্পিত কুকি-চীন ষ্টেট থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে উচ্ছেদ করবে। এর পেছনে সেনাবাহিনী ও ইসলামী জঙ্গীদের গোপন মদদ রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
“জনগণের জানমাল রক্ষার” অজুহাত দেখিয়ে কেএনএফের ফেসবুকে ২৩ জুন ২০২২ দেয়া এক স্টাটাসে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে যে, “প্রয়োজনবোধে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি’র ডেঞ্জারাস কমান্ডো টিম ‘ফেরোসিয়াস ওয়াইল্ড বোর (এফডব্লিউবি) টিম’ অত্রাঞ্চলে আরও আনাচে-কানাচে অপারেশন চালাতে বাধ্য হবে।”
সেই নীলনক্সার অংশ হিসেবে বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে মর্মে অজুহাত তুলে কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা গত ২১ জুন সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ও গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের কুপিয়ে একই পরিবারের পিতা-পুত্রসহ ৩ জন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যা এবং ২ অবুঝ শিশুকে গুরুতর আহত করে। আহত ২ শিশু হচ্ছে ঘটনায় নিহত সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরার সন্তান। গুলিবিদ্ধ দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রী কোনরকমে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।
নিহত সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, সেদিন কুকি চিন সন্ত্রাসীরা ২৫-৩০ জনের গ্রুপ আকস্মিকভাবে গুলি করতে করতে পাড়ায় ঢুকে পড়ে এবং তাঁদেরকে হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাঁরা সাধারণ জুমচাষী ও খেটে-খাওয়া মানুষ বলার পরেও অতর্কিত গুলি করে হত্যা করে এবং গলা কেটে মাথা বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। তাঁদের সেখানে কোন সশস্ত্র গ্রুপের মানুষ গিয়ে অবস্থান করেন না। কিন্তু এটা বলার পরেও তারা গুলি করে মেরে চলে যায় বলে নিহতের স্ত্রী আরো জানান (Maiphang Tipra-এর ফেসবুক স্টাটাস, ২৬ জুন ২০২২)।
এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাই নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে বমপার্টির সন্ত্রাসীরা নিহত ব্যক্তিদেরকে জেএসএস সন্ত্রাসী হিসেবে তকমা লাগিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায় এবং আহত দুই শিশুকে তারা উদ্ধার করে চিকিত্সা দিয়েছে বলে দাবি করে, যা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে আহত দুই শিশুর মা জানান।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ও ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম কর্তৃক প্রতিবাদ করায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ফেইসবুকে নানা হুমকিমূলক বার্তা প্রদান করে চলেছে। রেইংখ্যং এলাকা এবং রোয়াংছড়ির আশেপাশের তঞ্চঙ্গ্যা এবং ত্রিপুরা পাড়াগুলোতে সশস্ত্র অবস্থায় গিয়ে গ্রামবাসীদেরকে গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে চলেছে।
গ্রাম ছেড়ে চলে না গেলে গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে এবং সাইজাম পাড়ার মতো গুলি বর্ষণ করবে বলেও হুমকি প্রদান করেছে সন্ত্রাসীরা। ইতিমধ্যে বিলাইছড়ি বড়থলি ইউনিয়নের ৪টি পাড়া এবং রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের ২টি পাড়া ত্যাগ করে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এভাবে সাইজাম পাড়ায় একপ্রকার নৃশংস গণহত্যা চালানোর পর বমপার্টির সন্ত্রাসীরা এখন তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা গ্রাম উচ্ছেদের নীলনক্সা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। এর ফলে এখন তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা পাড়াগুলোতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের মালামাল বহনে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা প্রদান:
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা গেছে যে, গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) কুকি-চিন পার্টির ৪/৫ জন সন্ত্রাসী পাবলিক সেজে বান্দরবান সদরে গিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করেছে। দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে ছিল ১৫ বস্তা চাউল, এক বস্তা পেয়াজ, এক বস্তা রসুন, এক বস্তা ডাল, সিদোল দুই বস্তা ও আলু দুই বস্তাসহ অন্যান্য সামগ্রী। বমপার্টির সন্ত্রাসীরা যে গাড়িতে করে মালামাল বহন করে এনেছিল তা বান্দরবান সিরিয়াল লট নং ২৬ বি সেভেন্টি বলে জানা গেছে।
সূত্রে আরো জানা যায় যে, উল্লেখিত মালামাল নেয়ার সময় রোয়াংছড়ির দুর্নিবার বম পাড়া আর পানখেয়াং বম পাড়া এলাকাকে ঘিরে করে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ৫০/৬০ জন সেনাবাহিনী সদস্য সক্রিয় অবস্থায় টহলরত ছিল বলে জানা যায়।
বান্দরবান সদর হতে সরবরাহকৃত মালামাল দুর্নিবার বম পাড়া ও পানখেয়াং বম পাড়া হয়ে রনিন পাড়া পৌঁছা পর্যন্ত সেনাবাহিনীরা সক্রিয়ভাবে টহল দেয়। মালামাল পৌঁছে দেওয়ার পর যখন মালামাল বহন করা গাড়িটি ফিরে যায় তখন সেনাবাহিনীরাও নিরাপত্তা টহল শেষ করে ক্যাম্পে চলে যায় বলে জানা যায়।