সজীব চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। প্রধানমন্ত্রীর সামনেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি। চুক্তির পর খাগড়াছড়িতে প্রথম অস্ত্র জমাদানের দিন সন্তু লারমা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পাহাড়ের নেতা সন্তু লারমা ও আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এমপি নিজের হাতে শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী সেদিন ঐতিহাসিক মুহূর্তের বক্তৃতায় পাহাড়ের মানুষ ও দেশবাসীকে সেই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির অমৃত বাণীও শোনান। বলতে গেলে সেই সময়ে কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও ইউপিডিএফ’এর নেতৃত্বাধীন কিছু পাহাড়ি ছাত্র-যুবক বাদে অধিকাংশ পার্বত্যবাসীই চুক্তিটিকে স্বাগত জানান। সর্বস্তরের পাহাড়ি জুম্ম জনগণের মধ্যে যেমনি, তেমনি পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক আশা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সেই সময় চুক্তির সমর্থনে স্থায়ী বাঙালিদের দ্বারা ‘আদি ও স্থায়ী বাঙালি কল্যাণ পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনও সৃষ্টি করা হয় (২০০৭-২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন যে সংগঠনটির একাধিক নেতাকর্মীকে আটক, নির্যাতন করে, হুমকি ও জেলে দিয়ে সংগঠনটিকে অকার্যকর করে দেয়)। আর দেশে-বিদেশেও পার্বত্য চুক্তিটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এই চুক্তির ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আর যারা চুক্তির বিরোধীতা করেছিলেন তারাও আসলে দেশে-বিদেশে ও স্থানীয়ভাবে জনগণের সমর্থন পাননি। বিএনপি-জামাত নেতৃত্বাধীন বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং নবসৃষ্ট ইউপিডিএফ’এর নেতৃত্বে পাহাড়ি ছাত্র-যুবকদের মধ্যে সামান্য একটি অংশ মূলত বিরোধীতা করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা সাধারণ জনগণের উল্লেখযোগ্য সমর্থন আদায় করতে পারেননি। বিএনপি-জামাতের বক্তব্য হলো, এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম-ফেনী পর্যন্ত ভারতের হাতে চলে যাবে। অর্থাৎ এতে বাঙালিদের স্বার্থতো নেই, অঞ্চলটাও ভারতের হাতে চলে যাবে। অপরদিকে ইউপিডিএফ’এর বক্তব্য হলো, চুক্তিটি একটি আপোষ চুক্তি। এই চুক্তিতে জুম্ম জনগণের জন্য কিছুই নেই। জেএসএস পঁচে গেছে। ইউপিডিএফই প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি, চীনা বিপ্লবীদের স্টাইলে তারা বলে থাকেন ‘নয়া যুগের নয়া পার্টি’। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ছাড়া জুম্মদের মুক্তির পথ নেই। আর এজন্য জেএসএস চুক্তি করে অস্ত্র জমাদান করে আত্মগোপন অবস্থা থেকে বের হওয়ার পরপরই ইউপিডিএফ’এর অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেলেন এবং অস্ত্র হাতে নিতে শুরু করেন। তবে পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এসেও চুক্তি বাতিলের কথা বলেনি, উপরন্তু তার আমলে কিছু সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ চুক্তির কিছু ধারা বাস্তবায়িত হয়। অপরদিকে ইউপিডিএফ কখনো সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, বরং জেএসএস’এর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধেই তার অধিকাংশ শক্তি প্রয়োগ করে। তবে একপর্যায়ে বিভিন্ন সময় তারাও চুক্তির পক্ষে কথা বলতে শুরু করে।
বস্তুত জনগণের ব্যাপক সমর্থন, সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐকমত্য এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কারণে পার্বত্য চুক্তি অপরিসীম গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আর এই চুক্তির পশ্চাতে যে একটা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও ছিল তাও উল্লেখযোগ্য। ঐ সময়ে পৃথিবীতে কেবল পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। সোভিয়েট রাশিয়ার পতনকে কেন্দ্র করে এবং তার অব্যবহিত পরে শীতল যুদ্ধ অবসানোত্তর যে এককেন্দ্রিক নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি হয় তার সাথে তাল রেখে এধরনের আরও অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেদিক থেকে হিসাব করলে আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চুক্তিটি ছিল যুগোপযোগী। পার্বত্য চুক্তির একটু আগে ও একটু পরে সেই সময়ে বিশ্বের নানা দেশে জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয় সেগুলিকে সমাধানের জন্য অন্তত ২০টির মত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গবেষণা থেকে জানা যায়, এক/দুইটি বাদে এসব অধিকাংশ চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ বছরের মধ্যেই ৮০% হতে ৯৫% ভাগ বাস্তবায়িত হয়।
সবচেয়ে বড় কথা পাহাড়ের সাধারণ মানুষ, দেশের মানুষ চাইছিলেন পার্বত্য সমস্যাটির একটা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক এবং দুই দশকের অধিক চলা সরকারি বাহিনী ও শান্তিবাহিনীর মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হোক এবং যুগ যুগ ধরে শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার জুম্মরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাক। ফলে পাহাড়ের জুম্ম জনগণসহ দেশের সকল শান্তিকামী মানুষ এই চুক্তি স্বাক্ষরকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করে। চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করার কথা ঘোষণা ও বিধান করা হয়। বলাবাহুল্য, সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে এতদিনে চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে পারতো। অধিকাংশ মৌলিক বিষয় সহজেই বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। এতে চুক্তি নিয়ে যেটুকু বিরোধীতা ও বিভ্রান্তি ছিলো তা কাটিয়ে ওঠা সহজতর হতো। অন্যান্য সমস্যা থাকলে সে সব সমস্যা নিয়েও আলোচনা ও সমাধান খুঁজে বের করাও সহজতর হতো। নিঃসন্দেহে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এতদিনে আরো অনেক সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারতো।
কিন্তু বিগত ২৪ বছরেও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় এবং সরকারি মহল কর্তৃক প্রতিনিয়ত চুক্তি লংঘন করে চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আবারো জটিলতর ও বিস্ফোরন্মুখ হয়ে উঠেছে। চুক্তির পরপরই প্রধানমন্ত্রী মুক্ত আকাশে যে শান্তির পায়রা উড়িয়েছিলেন তাঁর সরকারই আজ সেই পায়রাটিকে ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ করে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত ও সংঘাতময় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির যে সম্ভবনার দুয়ার খুলে গিয়েছিল কায়েমি স্বার্থবাদীদের খপ্পরে পড়ে সরকার নিজেই আজ সে সম্ভবনাকে পদদলিত করে চলেছে।
সরকার চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করলেও সেটি চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকা পালন করছে না। বরং সেটি চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্রেই অধিকতর লিপ্ত রয়েছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও সরকারের চুক্তি বাস্তবায়ন বিরোধী নীতি ও সরকারি মহলের চুক্তি বিরোধী ষড়যন্ত্রের কারণে সেগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারছে না। তাছাড়া চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হলে এই পরিষদসমূহ চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য অধিবাসীদের স্বার্থে কাজ করতে পারবে না। সেই কারণেই বিগত ২৪ বছরেও এই পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পরিষদ গঠন করা যায়নি এবং কোনো জবাবদিহি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে এই প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রকৃত সেবা থেকেই জনগণ বঞ্চিত রয়েছে।
পরিতাপের বিষয় হলো, বিগত ২৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চুক্তিতে যে মৌলিক বিষয় বা ধারাগুলো সন্নিবেশিত হয় সেগুলো একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। কোনো কোনোটি এখনো প্রাথমিক অবস্থাতেই রাখা হয়েছে। সাড়ে পাঁচশটির অধিক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের কথা থাকলেও ২০০৯ সাল পর্যন্ত একশটির মত প্রত্যাহার করা হলেও বাকীগুলো বহালতবিয়তে রয়েছে। এমনকি আরো অন্তত ২০টির অধিক নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এখনো সেনাশাসন অপারেশন উত্তোরণ প্রত্যাহার করা হয়নি। পার্বত্য সমস্যার অন্যতম মূল সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়নি এবং এমনকি একজন জুম্মও তার বেহাত হওয়া ভূমি ফেরত পায়নি। উপরন্তু চুক্তির পরও বহু জুম্মর ভূমি সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেদখলের শিকার হয়েছে। ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীরা কিছু আর্থিক সহায়তা পেলেও তাদের ভূমি ফিরে পায়নি এবং পুনর্বাসনের সুযোগ পায়নি। অপরদিকে চুক্তি মোতাবেক অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুরাও কোনো সহায়তা পায়নি এবং জমিজমা ফিরে পায়নি। আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা হয়নি। স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধভাবে পুনর্বাসিত বহিরাগত সেটেলারদের সম্মানজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এই সমস্ত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হলে কীভাবে চুক্তির সুফল পাবে মানুষ? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে?
সরকার এখন চুক্তি বাস্তবায়ন না করে এবং চুক্তির অপর পক্ষ জনসংহতি সমিতি ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনোরূপ আলোচনা না করে উন্নয়নের নামে একের পর এক সীমান্ত সড়ক, স্থল বন্দর নির্মাণ, রাবার চাষ ও হর্টিকালচারের নামে বহিরাগতদের নিকট ভূমি ইজারা প্রদানসহ জুম্মদের জীবন-জীবিকা বিধ্বংসী নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। সেনাবাহিনীও চুক্তি লংঘন করে একের পর এক বিলাসবহুল পর্যটন স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে। সরকার ও সরকারি বাহিনীর এসব কার্যক্রমের কারণে শত শত জুম্ম পরিবার নতুন করে বাস্তুভিটা হারানো ও উচ্ছেদের মুখে পড়েছে। এভাবে আবার জুম্মদের ক্রমাগত স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস ও অধিকতর প্রান্তিকীকরণসহ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, চুক্তির পরেও প্রশাসনের মদদে ও ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক জুম্মদের উপর ২০টির অধিক বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা, শত শত বাড়ি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভূমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনার কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারই হয়নি।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিগত সময়ে ক্ষমতায় না থাকা বা অন্য দলের ক্ষমতায় থাকার অজুহাত দেখালেও, দীর্ঘ ১৩ বছরের অধিক একনাগাড়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও বর্তমান সরকার এই সময়ে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণই বন্ধ রেখে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে বর্তমান সরকার পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের কার্যক্রম জোরদার করেছে। এটা সমস্যার সমাধান তো নয়ই, বরং চুক্তির সরাসরি লংঘন এবং পুরনো কায়দায় বল প্রয়োগ করে জুম্মদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সোচ্চার কন্ঠকে রুদ্ধ করার এবং চুক্তি বাস্তবায়নসহ জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নাৎসী কায়দায় আঘাত করা ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুত বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির পূর্বের মতই অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় সামরিক শাসন পুনস্থাপন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, উন্নয়নমূলক, সামাজিক জীবন ও জীবিকা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে আবার সেনাবাহিনীরই কর্তৃত্ব ও হস্তক্ষেপ কার্যকর করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব, অভিযান, তল্লাসী, নির্যাতন, আটক, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রেপ্তার ইত্যাদি তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। অপরদিকে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জুম্মদের মধ্য থেকে চুক্তি বিরোধী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সেগুলিকে জনসংহতি সমিতি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ চুক্তির পক্ষের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে এলাকায় এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
শুধু বিগত পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে ২০২২) পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তাবাহিনী কর্তৃক মোট ৫২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং তাতে অন্তত ১২৮ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। এতে অন্তত ৪ ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যা, জনপ্রতিনিধিসহ ২৮ ব্যক্তি গ্রেপ্তার, ৪৬ ব্যক্তি সাময়িক আটক ও নির্যাতন এবং অনেকে মিথ্যা মামলা, হুমকি ও বাড়ি তল্লাসীর শিকার হয়েছেন। এই সময়ে সেনামদদপুষ্ট সংস্কারপন্থী জেএসএস, ইউডিপিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি, কুকি-চিন পার্টি খ্যাত কেএনএফ ইত্যাদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ১৪ জন খুন, ১৯ ব্যক্তি সাময়িক অপহরণ ও অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় এবং অনেকেই মারধর, হুমকি ও হত্যার চেষ্টার শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ গত ২১ জুন ২০২২ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:০০ টার দিকে সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়া গ্রামে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে একই পরিবারের ২ জনসহ ৩ জন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যা এবং ২ শিশুকে গুরুতর আহত করে। এই নৃশংস হত্যাকান্ডে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝর উঠলেও বিগত ১৩ দিনেও প্রশাসন এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি এবং অভিযুক্ত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করেনি।
বলাবাহুল্য, পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন বন্ধ রেখে এবং পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয় এবং এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বরং দিনের পর দিন এভাবে চললে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সুদূর পরাহত। কোনো উন্নয়ন ও অর্জনই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ ও বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। চুক্তি স্বাক্ষর করে যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশে শান্তির পায়রা উড়িয়েছিল সেই সরকারই কী শেষ পর্যন্ত সেই শান্তির পায়রাটিকে গলা টিপে হত্যা করবে? পাহাড়ের মানুষ শান্তি চায়, সমস্যার সমাধান চায়। পাহাড়ের মানুষ ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়। সেই ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা না থাকলে তারা কীভাবে শান্তিতে থাকবে?