বিজয় বিকাশ ত্রিপুরা
জুম পাহাড়ে শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের যে বীজ বপন করেছিল, জুম্ম জাতির অধিকারের সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে সেই সংঘাতের বীজ থেকে ইউপিডিএফ নামক একটি বিষ বৃক্ষের জন্ম! শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করলো ঠিকই কিন্তু ‘ভাগ কর শাসন কর’ বিভাজন নীতির অপকৌশল হিসেবে ইউপিডিএফের বিষাক্ত তীরটি বিদ্ধ করলো জুম্ম জাতির অধিকার ও অস্তিত্বে! সেই ১৯৮৩ থেকে এখনও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বিভেদ-বিভাজনের ষড়যন্ত্র, নানা ঘটনা প্রবাহ চলমান রয়েছে। ইউপিডিএফ নেতারা জুম্ম জনগণকে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের মুখরোচক গালগল্প শুনালেও তারা এখন সার্কাস খেলার পুতুল! জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্তরায় হিসেবে ইউপিডিএফ নামক এক কালো জগদ্দল পাথর জুম্ম জনগণের বুকে চেপে বসেছে। প্রসিত বিকাশ খীসার ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতালিপ্সু চরিত্র জুম্ম জনগণের কাছে বারবার উন্মোচিত হয়েছে। তাই কথিত পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের বুলি আওড়ানো নীতি-আদর্শহীন, জুম্ম স্বার্থবিরোধী ইউপিডিএফ রাজনীতি আজ শাসক-শোষকগোষ্ঠীর ক্রীড়ানক! জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রচার করে থাকে যে তারাও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন চায়! এটা শুধু মুখের কথা, রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজির ভন্ডামী ছাড়া কিছু নয়।
জুম্ম জাতীয় ঐক্য আর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের সাথে ঐক্য এক কথা নয়। জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ আছে। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় আস্থা ও বিশ্বাসের একমাত্র ভরসাস্থল হলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। জুম্ম জনগণ এখনও বিশ্বাস করে একমাত্র জনসংহতি সমিতিই শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের ২৪ বছরের কথিত পূর্ণস্বায়ত্তশাসন নামক দাবি অন্ত:সারশূন্য ফাঁকাবুলি সেটা একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় কথিত চুক্তি আকারে পেশকৃত দাবিনামাতেই প্রমাণিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দের চেয়ে ইউপিডিএফ তথা প্রসিত বিকাশ খীসার হাড়হদ্দ কে বেশি ভালো জানে? যারা দীর্ঘ দু’দশক ধরে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার ত্যাগ-তিতিক্ষাকে হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছিলেন, যে লড়াইয়ে বহু বীর যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের আন্দোলনের ফসল হিসেবে আজ অনেকেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু ক’জন এসব বিষয় নিয়ে ভাবে? আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ অসহনীয় দু:সহ জীবন কাটিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন সেই বিপ্লবী নিরস্ত্র বীর যোদ্ধাদের প্রসিত খীসার নির্দেশে নিষ্ঠুরভাবে একে একে হত্যা করতে শুরু করলো ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা! বিশেষত পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরের দিনগুলোতে গ্রামে-গঞ্জে এমন কোন দিন অতিবাহিত হয়নি, যেদিন ইউপিডিএফ কর্তৃক কোন না কোন নিরস্ত্র বীর বিপ্লবী যোদ্ধাকে হত্যা করেনি।
সময়ের সাথে সাথে প্রত্যাগত জেএসএস সদস্যদের হত্যার তালিকা দীর্ঘ হতে থাকলো। রক্তের হোলিখেলায় উন্মাদ ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা বলতে শুরু করলো- জেএসএস শেষ! তারা জনসংহতি সমিতির নেতা, কর্মী, সমর্থক ও নিরীহ মানুষকে হত্যা, অপহরণ, গুম, মুক্তিপণ আদায়, নির্যাতন চালিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল নিরব দর্শক! ফলশ্রুতিতে ইউপিডিএফকে প্রতিরোধ করার জন্য বিক্ষুদ্ধ ভুক্তভোগীরা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পক্ষের সচেতন কিছু ব্যক্তি জীবন বাঁচাতে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। তারা নানা মহলে নানা নামে তাদের পরিচিতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম এখনো চলছে। এক সময় শাসকগোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের মদদে বহু জায়গায় চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা জুম্ম জনগণকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল, জুম্ম জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়িয়েছে। রাঙ্গামাটির রাজস্থলী, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি থেকে তাদের বিতাড়িত করেছিল।
দীর্ঘ সাত বছর পর চুক্তি বিরোধী প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ ও চুক্তি পক্ষের মধ্যে আবার হঠাৎ নতুন করে সংঘাত শুরু হলো কেন? এ প্রশ্ন অনেকের। গত ১২ জুলাই ২০২২ ইউপিডিএফের কমান্ডার জীবন ত্রিপুরা নিহতের ঘটনায় একতরফাভাবে জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করা হচ্ছে এবং এ ঘটনাকে ফলাও করে প্রচারের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতিকে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনের প্রেক্ষাপট কি শুধু এ ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আসুন- এ সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যের ঘটনা প্রবাহ একটু বিশ্লেষণ করি। এতে পাঠকরা প্রসিত গংদের চাতুরতা সম্পর্কে বুঝতে কিছুটা হলেও সুবিধা হবে।
কয়েক মাস ধরে লোকমুখে যখন প্রচার হতে থাকলো প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে! এদিকে হঠাৎ করে ইউপিডিএফ নেতাদের আচরণ, কথা-বার্তাও পরিবর্তন হতে থাকে! তারা চুক্তিপক্ষের লোকজনকে হুমকি দিয়ে এখানে আসতে পারবে না, ওখানে যেতে পারবে না ইত্যাদি নানা বাধা নিষেধ জারি করে। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেফতারি পরোয়ানায় ফেরারী ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী নেতা-কর্মীরা হঠাৎ প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে! জনগণের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে, মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়। ইউপিডিএফ কি আবার নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করছে?
অত:পর গত ৯ জুন ২০২২ ইউপিডিএফ (প্রসিত) সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলামের মধ্যস্থতায় একটি দাবিনামা সেনাবাহিনীর হাতে পেশ করে। এখবর প্রচার হওয়ার সাথে সাথে খাগড়াছড়িতে লোকমুখে আরো প্রচার হতে থাকে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ নেতারা মামলায় ফেরারী জীবন থেকে মুক্তি ও নিজেদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি করে গোপনে অস্ত্র সমর্পন করবে। এনিয়ে জুম্ম জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। জনগণ বলতে লাগলো- ইউপিডিএফের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন কোথায় গেল? কেন তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত ও বিরোধীতা করলো? পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা, সমাবেশ, কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে জনগণকে কেন বাধা দিয়েছে? কেন ইউপিডিএফ প্রত্যাগত জনসংহতি সমিতির বিপ্লবী সদস্যদের হত্যা করেছে? চুক্তি সমর্থিত জুম্ম জনগণকে জিম্মি করে, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায় করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে ইত্যাদি।
ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধীতা ও চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি। বহুবার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে হত্যা করার চেষ্টাও করেছে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভায় যোগ দিতে খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার গাড়ি বহরে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা তিন দফা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। এ সময়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহকারী উপদেষ্টা ও চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের গাড়িতেও হামলা করা হয়। এছাড়া সমাবেশে গ্রেনেড হামলার চেষ্টা, বাসভবন ও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে বোমা হামলার জন্যও লোক পাঠায় প্রসিত খীসা। ২০১৩ সালে লংগদুর কাট্টলী বিল থেকে জনসংহতি সমিতির ৭০ জন সদস্যকে গণঅপহরণ ও তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা এখনো এলাকাবাসীকে আতঙ্কিত করে থাকে।
ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের নিয়ে নানা নৃশংসতার লোমহর্ষক কাহিনী আজও রাঙ্গামাটির সুবলং, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও রাজস্থলী এলাকার মানুষদের মুখে মুখে। সুবলং বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সমর্থককে দা দিয়ে কুপিয়ে মস্তকচ্ছেদ করে উল্লাস প্রকাশ করেছিল! এলাকাবাসী ওই ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের অঙ্গুলিমালা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। এমন নৃশংসতার লোমহর্ষক ঘটনাগুলো জুম্ম জনগণ এখনও ভুলে যায়নি। থাক সে প্রসঙ্গ।
সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের কাছে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফের দাবিনামা পেশের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং ওই দাবিনামায় কি আছে সেটা জনগণের কাছে প্রকাশের দাবি জোরালো হয়ে উঠে। পরে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ সে দাবিনামা (৬৬ পৃষ্টার পিডিএফ কপি) প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। সেটা পড়ার পর জুম্ম জনগণের মধ্যে আরো ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাদের ক্ষোভের কারণ হলো- ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার স্থায়ী অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ সংশোধনের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে! যে পার্বত্য চুক্তিকে তারা জুম্ম অস্তিত্ব বিরোধীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে বিরোধীতা করেছিল, সে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফের দাবিনামায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে অসম্পূর্ণ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মৌলিক দাবিগুলো পূরণ হয়নি উল্লেখ করে নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করতে পার্বত্য চুক্তিকে নকল ও সংশোধন করলো! এবিষয়ে প্রসিত খীসা কি জনসংহতি সমিতির নেতাদের সাথে কোন আলাপ-আলোচনা করেছে?
ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীরা চুক্তিপক্ষের লোকজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার অনেক দিন ধরে অছিলা খুঁজতে থাকে! চুক্তিপক্ষের লোকজনকে অস্ত্র তাক করে হত্যার হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীরা হঠাৎ সশস্ত্র মহড়া দিতে থাকে। ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীরা চুক্তিপক্ষের লোকজনের উপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন খবর পেয়ে চুক্তিপক্ষের লোকজন দ্রুত পাল্টা হামলা চালায়। পানছড়ি ও দীঘিনালায় ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী সন্ত্রাসীদের সাথে চুক্তিপক্ষের লোকজনের একযোগে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জুম্ম জনগণের সহযোগিতা না পেয়ে ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী সন্ত্রাসীরা এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীর সামরিক কমান্ডার জীবন ত্রিপুরা নিহত হয়। সুতরাং জীবন ত্রিপুরা নিহতের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফের হঠকারী সিদ্ধান্তে জীবন ত্রিপুরা নিহত হয়েছে। ২০১০ সালের দিকে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা যখন রাঙ্গামাটির রাজস্থলীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সে সময়ে রাজস্থলীতে জীবন ত্রিপুরা জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীসহ চুক্তি পক্ষের বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল।
সম্প্রতি প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ কর্তৃক নানা অপতৎপরতায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে- পানছড়িতে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলামের মধ্যস্থতায় পেশকৃত দাবিনামা ছিল লোক দেখানো। মূল উদ্দেশ্য হলো- ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীদের দিয়ে পূর্বের ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধীতা ও সেনাবাহিনীর স্ক্রীপ্ট অনুযায়ী নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করা। এটাই সেনাবাহিনীর সাথে ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীদের চুক্তি! চুক্তিপক্ষের লোকজনের উপর হামলা চালানোর গোপন চুক্তি! ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী নেতাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চুক্তি! দেখা যাচ্ছে এ চুক্তির পর ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীরা রাজপথে এখন বেশ সরব! গত ২০ জুলাই ২০২২ ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় সংলগ্ন সড়কে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে। মানববন্ধনে জেএসএস’এর প্রতি কথিত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও অনুষ্ঠানে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার প্রতি অকাট্য ও অমার্জিত ভাষায় বিষোদগার করা হয়।
ইউপিডিএফের উক্ত মানববন্ধনে যে বক্তব্য ও শ্লোগান দেয়া হয়েছে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জনসংহতি সমিতি। এধরনের বক্তব্যকে আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক, উস্কানিমূলক, মানহানিকর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত উল্লেখ করে তা প্রত্যাহার ও পরিহার করার আহ্বান জানান। কিন্তু হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ গত ২৩ জুলাই ২০২২ জনসংহতি সমিতি কর্তৃক বক্তব্য প্রতাহারের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। একইভাবে প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ গত ২৪ জুলাই ২০২২ সকালে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন অনুষ্ঠানে বিষোদগার করেছে। অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, অপমান, কুৎসা রটানো, অপপ্রচার করাই ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থী নেতা-কর্মীদের স¦ভাবজাত বৈশিষ্ট্য। এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ইউপিডিএফ প্রসিতপন্থীদের কঠোর সমালোচনা করছে। এধরনের একগুঁয়েমি কর্মসূচি বন্ধ না করলে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্য প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফকেই সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় এমন খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরতে ইউপিডিএফকে ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে চুক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক এ অজুহাতে সেনা কর্তৃত্ব তথা ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন বলবৎ রাখার জন্য কৃত্রিম অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। এছাড়া ইউপিডিএফকে লেলিয়ে দিয়ে অপহরণ, হত্যা, গুমের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতিকে নেতৃত্বশূন্য ও কোনঠাসা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করাই ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য। আর অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
গাঁধা নাকি পানি ঘোলা করে খায়! কারণ হলো পরিষ্কার পানিতে নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই নিজেকে খাচ্ছে ভেবে ভয় পায়। প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফ নেতাদের চরিত্রও আজ সে রকম হয়েছে। তারা আজ জেএসএস ফোবিয়ায় আক্রান্ত, সব কিছুতে জেএসএসকে দেখে! জেএসএসকে ভয় পায়। সন্তু লারমা মৃত্যু কামনা করবে, ফাঁসির দাবি করবে, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য রাখবে আর মুখে ঐক্য-ঐক্য করে গলাবাজি করবে! যে দল ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের জনক, সেই ইউপিডিএফ আবার বড় গলায় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়! যার জন্ম বিভেদকামিতার গর্ভেই, সেই ইউপিডিএফ আবার জাতীয় ঐক্য নিয়ে গলাবাজি করে! প্রসিত খীসার প্রতি আহ্বান হলো- এমন রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজির চরিত্র পরিবর্তন করুন, অশুভ দুষ্ট চক্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসুন। সেটাই জুম্ম জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
সব কথার শেষ কথা। ইউপিডিএফের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থপরিপন্থী সন্ত্রাস নয়, বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানই সকলের ঐকান্তিক কাম্য।