হিল ভয়েস, ১ জুলাই ২০২২, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: গতকাল ৩০ জুন ২০২২ খ্রি: পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখার উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আয়োজিত “শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুনার্মেন্ট-২০২২” এর সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগ্রামী সভাপতি সুমন মারমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানুচিং মারমা এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগ্রামী সভাপতি নবোদয় চাকমা এবং সাধারণ সম্পাদক নরেশ চাকমার সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন টুর্নামেন্টের আহ্বায়ক অন্বেষ চাকমা। খেলার শুরুতে শহীদ ছাত্রনেতা মংসচিং মারমার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম মহোদয় ফাইনাল খেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, “ছাত্রদের জন্যই আমরা শিক্ষক। তাই ছাত্রদের যেকোনো প্রোগ্রামে অতি উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করি। খেলাধুলা শুধু হারা অথবা জেতার জন্য না বরঞ্চ খেলাধুলা হলো সম্পর্ক ভালো করার অন্যতম মাধ্যম।” তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুমন মারমা বলেন, “শহীদ মংচসিং মারমা ২০১২ সালে রাঙ্গামাটিতে পিসিপি সম্মেলন শেষে ইউপিডিএফ এর তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) নেতৃত্বে গ্রেনেড হামলা করা হয় সেখানে গুরুতর আহত হন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা যেহেতু একটি রাষ্ট্রে আছি, এই রাষ্ট্রের মধ্যে আমরা শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত এক একটি জাতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকশ্রেণি কর্তৃক প্রতিনিয়ত হত্যা, নির্যাতন, গুমের ঘটনা ঘটছে। এসব থেকে দীর্ঘস্থায়ী মুক্তি পাওয়ার লক্ষেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি হয়।”
তিনি আরো বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদেরকে শুধু একাডেমিক পড়াশুনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস এবং পার্বত্য চুক্তি নিয়েও পড়াশোনা করতে হবে। এছাড়াও আমাদের যার যার অবস্থান থেকে মেধা-প্রতিভা নিয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে হবে। তথাগত গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, বিচার-বিশ্লেষণহীনভাবে কোনোকিছু গ্রহণ করা ঠিক না। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনটা ন্যায়সংগত আন্দোলন, কোনটা ঠিক অথবা বেঠিক, আবার কোনটা আসলেই আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে উপযোগী, কোনটা উপযোগী না সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রহণ করা উচিত।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল চাকমা বলেন, “এইরকম ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন শুধু খেলাধুলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার জন্য ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানান।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানুচিং মারমা বলেন, “শহীদ মংচসিং মারমা একজন সংগ্রামী, প্রতিবাদী ও অধিকারকামী ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি জুম্ম জাতির জন্য নিজের জীবন আত্মবলিদান দিয়েছেন। তার এই অবদান সকল জুম্ম তরুণদের যুগে যুগে স্মরণ করা উচিত।” তিনি জাতির পরিচয় ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে সকলকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
পিসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “আমাদের সকল শোষিত আদিবাসী জাতিসত্তার একতা গঠনে এই ধরনের খেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।” তিনি পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের সভাপতি নবোদয় চাকমার বক্তব্যের মাধ্যমে আলোচনা সভা এবং পুরস্কার বিতরণের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
এবারের আসরে মোট ১২ টি দল অংশগ্রহণ করেছে। অনেক বাঁধা পেরোনোর পরে অবশেষে টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় অংশগ্রহণ করে টিম তাজিংডং (১৮-১৯ সেশন) ও টিম ইনক্রেডিবলস (১৭-১৮ সেশন)। খেলায় ইনক্রেডিবলস তাজিংডংকে ৪-২ গোলে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এছাড়াও ম্যান অফ দ্য ফাইনাল নির্বাচিত হন ইনক্রিডিবলস এর অধিনায়ক প্রেনচুং ম্রো। প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন তাজিংডংয়ের খেলোয়াড় দেব চাকমা। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে নির্বাচিত হন যৌথভাবে ইনক্রেডিবলসের মেনপং ম্রো ও চিম্বুকের প্রান্তর চাকমা (তাদের উভয়ের গোলসংখ্যা ৬ টি) এবং সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন ইনক্রেডিবলসের সঞ্জয় ত্রিপুরা।
উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালের ২০ মে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ছাত্র ও জনসমাবেশে যোগদান শেষে ফেরার পথে রাঙ্গামাটির কল্যাণপুরস্থ পেট্রোল পাম্পে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় ছাত্রনেতা মংচসিং মারমাসহ কাপ্তাই সুইডিশ ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। মংচসিং মারমাকে মারাত্মক আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করানোর দুইদিন পরে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির স্মরণে ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এই ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করে আসছে।